পতিতা শেষ পর্ব | Potita লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

এতো দিনে অয়নের স্পর্শ, অয়নের গন্ধ, অয়নের অনুভূতি সব কিছুই বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছি। তাই আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা অয়ন।

সে নিজেও কিছু বলছে না শুধু আমাকে জড়িয়ে আছেন। তার নাক আমার চুলে ডুবিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমার মাথার পিছনের দিকে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে রাখলেন। অনেকটা সময় ওভাবেই দাড়িয়ে ছিলাম। আমার খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে অয়ন আমার স্বীকৃতি চাই। আমার সন্তানের সীকৃতি চাই৷ কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।

অয়ন আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। অয়ন বুঝে গেছে আমার কিছু একটা হয়েছে তাই আমি এমন চুপচাপ হয়ে গেছি। এটা ঠিক তার সাথে মন খুলে আমি কখনোই তেমন কোন কথা বলি নি তবে আমাদের মাঝে চাপা কথার আদান-প্রদান হতো। আমি মুগ্ধ নয়নে শুধু তাকে দেখতাম। ইদানিং আমার চাহনিতে সে শুধু ভয় দেখতে পায়। কিসের ভয় সে জানে না তবে কিছু হয়েছে সেটা সে আন্দাজ করতে পারছে।

তুবা আপু প্রতিদিন আমাকে ফোন দেয়, অনেক কিছু বলে বোঝায়। আমি যেনো নিজের জীবনটা নষ্ট না করি।

আমি না পারছি বাচ্চাটাকে ছাড়তে আর না পারছি বাচ্চার বাবার কাছে অধিকার দাবি করতে। কিসের অধিকার চাইবো তার কাছে। কি বলবো। আমার তো তার সাথে কোন সম্পর্ক নেই তাহলে কি বলবো তাকে আমি।

টুনি- আপনাকে ইদানিং অনেক বেশি অন্যমনস্ক লাগে দেখতে।

টুনির কথায় আমি হুদিশ ফিরে পেলাম।

টুনি- কি হয়েছে আপনার??? আপনার কি হয়েছে তা চিন্তা করে স্যারও অস্থির হয়ে থাকে। আপনারা দুজন দুজনার ভালো চান সুখ চান তাহলে কেনো একে অপরকে কিছু বলেন না। মনের চাপা কথা গুলোকে কেনো তুলে ধরছেন না একে অপরের কাছে।

রেনু- আমার পাশে একটু বসবে???

টুনি আমার পাশে বসতেই আমি টুনির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলাম।

রেনু- তোমার স্যারের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে??

আমার প্রশ্নে টুনি খানিকটা নড়ে চড়ে বসলো।

টুনি- আপনি কিভাবে..

রেনু- সেদিন তুমি তোমার স্যারের সব কথা বলেছো কিন্তু তার গল্পের আসল কথাটাই আমাকে বলো নি সে অন্য একজনের বাগদত্তা।

আমার কথায় টুনি মাথা নিচু করে ফেলল। হয়ত ওর নিজের মাঝে কোন অপরাধবোধ কাজ করছে। কারণ যে মানুষটার সাথে এতো দিন ধরে আমি তার বউয়ের মতোই আছি শুধু আমাদের কালেমা পড়ে বিয়েটা হয় নি। তার জীবনের গল্পটা আমার জানা তার এই কথাটাও আমাকে টুনির বলা উচিত ছিলো। অবশ্য এটাও ঠিক আমি তো তার বউ নই আর প্রেমিকাও নই হয়ত তাই আমাকে বলে নি। আমি তো তার জীবনে একজন অবাঞ্চিত নারী। আর অবাঞ্চিতদের জানার কোন অধিকার নেই।

টুনি- আসলে স্যার বিয়েটার জন্য রাজি ছিলেন না। কিন্তু খালম্মা মানে স্যারের মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর স্যারকে বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়। কিন্তু তাদের বিয়ে হয় নি তো।

রেনু- জানি তাদের এ্যাংগেইজমেন্ট হয়েছে আর বিয়েও ঠিক।

টুনি- প্রতিটা বাবা মাই তো চায় তাদের ছেলে মেয়েরা একটা সুন্দর জীবন কাটাক আর সোহা আপুর সাথে ঐ ঘটনার পর থেকে স্যার নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিলো। নিজের চোখের সামনে কোন মা তা সহ্য করতে পারে বলেন। তাই তো অনেক খুজে স্যারের ছোট খালার ভাসুরের মেয়ে তানিয়া আপুর সাথে বিয়ে ঠিক করেন। তানিয়া আপু অনেক সংসারি মেয়ে যে ঘরেই যাবে সেই ঘরকেই খুব সুন্দর করে আগলে রাখবে। আর স্যারের ছন্নছাড়া জীবনে যদি তানিয়া আপুর মতো কেউ আসে তাহলে তার জীবনটা হয়ত সুন্দর হয়ে উঠবে আবার। কিন্তু স্যার তখন একদম বিয়ে করবেন না বলে দেয়। বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পরেই খালাম্মা মারা গেলেন। তাই বিয়ের কথাটা কিভাবে যেনো চাপা পরে গেলো। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন???

রেনু- তারা এখন চায় বিয়েটা যতো যলদি সম্ভব হয়ে যাক।

টুনির মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ বের হলো না। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টুনি উঠে চলে গেলো।

দিন যতো যাচ্ছে সময় ততো ঘনিয়ে আসছে। আমাকে যলদি একটা ডিসিশন নিতে হবে। না হলে দেরি হয়ে যাবে। এতো গুলো মানুষের জীবন তো আমি নষ্ট করতে পারি না বা তাদের দুঃখেও ঠেলে দিতে পারি না।

একজন ভালো মানুষের জন্য আমার পরিবারটা আবার ভালো আছে। মাকে বাবার ঔষধ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আমার বোনগুলো ঠিকমতো লেখাপড়া করছে। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে কথা গুলো ভাবছি। মা আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।

রেনু- মা

মা- হ্যা বল।

রেনু- তোমরা ভালো আছো তো??

মা আমার কপালে একটা চুমু একে দিলো।

মা- আমার মেয়েটা আমাদের এতো ভালো রাখছে আমরা কি ভালো না থেকে পারিরে মা।

অনেক ভাবলাম অনেক। আমার সাহস নেই এই মানুষ গুলোকে কষ্ট দেয়ার বা সমাজের চোখে এদের ছোট করার। যে মানুষটার জন্য আমার জীবনে সুখ ফিরে এসেছে আমি তাকেও সুখী দেখতে চাই। আমার পরিবারটাকে অনেক ভালোবাসি অনেক। বাবা ছোট বেলা থেকে কোন কমতি রাখে নি। জীবনের চরম খারাপ মূহুর্তে এসে পেলাম অয়ন চৌধুরীকে। তার অনুমতি ছাড়াই তাকে ভালোবেসে ফেললাম। শুধু ভালোবাসি বললে কম হবে অনেক বেশি ভালোবাসি। আর তারই অংশ আমার ভিতরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। প্রতি নিয়ত আমাকে জানান দিচ্ছে মা আমি বড় হচ্ছি। আমার পরিবার, আমার অয়ন, আমার বাচ্চা যে কোন একজন কে বেছে নিতে হবে আমাকে। আমার জীবনে বাস্তবতার চরম মূহুর্ত পার করেছি আমি। তাই আমার অনাগত সন্তানের কথা জানতে পারলে যে সমাজে আমার পরিবারের থুথু হবে তাও জানি। আমার সন্তানের কথা শুনলে সত্যি সত্যি আমার বাবাটা মরে যাবে এবার তাও জানি। তাই আবার একটা নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাকে। আমি আবার তাই করলাম। সব শেষ করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাই নিলাম আমি।

তুবা আপুর সাথে দেখা করতে গেলাম আপুকে না বলেই আপুর বাসায় চলে গেলাম হুট করেই। আপু আমাকে দেখে অনেক অবাক হয় আর আমার কথা শুনে তো আরো অনেক বেশি চমকে যায়। কারণ সেদিন ক্লিনিক থেকে ফেরার পর আমি আর আপুর সাথে দেখা করি নি এমন কি ঠিক মতো কথাও বলি নি।

তুবা- কি বলছিস কি তুই এসব??? তোর মাথা ঠিক আছে???

রেনু- আছে আপু। আমার মাথা একদম ঠিক আছে। তাও যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই। কারণ এতে আমার কোন আফসোস থাকবে না। না হলে পরে যে সারাজীবন আফসোস করে কাটাতে হবে আপু।

তুবা- দেখ এসব হয় না।

রেনু- কি হয় না হয় জানি না। আমি এটাই চাই।

তুবা- আমি পারব না।

রেনু- প্লিজ আপু এতোদিন পর্যন্ত তো আমার জন্য কম করো নি। আর একটা বার প্লিজ না করো না।

তুবা- বললাম তো আমি পারব না।

রেনু- আপু তোমাকে আমার কসম না করো না।

আপু আমার মুখ চেপে ধরলেন।

তুবা- দিস না আমায় তোর কসম। আমি ফেলতে পারবো না।

রেনু- প্লিজ আপু আমার জন্য এই শেষ উপকারটা করো।

তুবা- ঠিক আছে তুই যা চাস তাই হবে। তবে মনে রাখিস শুধু তোর জন্য।

আজ আর অয়নের কাছে যাবো না তার কাছে কাল একে বারেই যাবো। তাই ফোন দিয়ে না করে দিলাম যেনো নিতে না আসে। মানুষটা বড্ডো বেশি চিন্তা করছে ইদানিং আমাকে নিয়ে। আর অল্প সময় তার পরেই তাকে তার সব চিন্তা থেকে মুক্তি দিবো।

সারারাত ঘুমাই নি। তাই সকাল সকাল বাসার সবার জন্য নাস্তা তৈরি করলাম।

মা- এ কি রে তুই কিচেনে কি করছিস??

রেনু- কেনো?? নাস্তা বানাই।

মা- তা তো দেখতেই পারছি কিন্তু তুই কেনো??

রেনু- কেনো মা আমি তোমাদের জন্য রান্না করতে পারি না বুঝি।

মা- পারিস তো। তাও দরকার নেই সর তো দেখি যা করেছিস করেছিস বাকিটা আমি করে নিবো।

রেনু- একদম না। তুমি যাও আমার পিচ্চিগুলোকে উঠাও আর বাবা কি উঠেছে??? না উঠে থাকলে বাবাকেও উঠাও আজ সবাই একসাথে খাবো।

মা- তুই গিয়ে উঠা আমি বাকিটা তৈরি করি।

রেনু- মা তুমি কি যাবে নাকি আমি রেগে যাবো???

মা- আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।

অনেক দিন পর সবাইকে নিয়ে নাস্তা করছি।

অনু- কিরে তনু এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেনো???

তুন- দেড়ি হলেই তো আবার বকা শুরু হয়ে যাবে স্কুলে যাওয়ার জন্য। তাই তো নাকে মুখে খাচ্ছি।

তনুর কথায় সবাই হেসে দিলাম।

রেনু- না আজ একদম বকবো না।

তনু- সত্যি???

রেনু- একদম সত্যি কারণ আজ স্কুলের ছুটি।

তুন- না স্কুল তো খোলা।

রেনু- খোলা তাও আজ আমার বাচ্চাটা আমার কাছে থাকবে সারাদিন। তাই আজ স্কুল যেতে হবে না।

তনু- ইয়াহুউউউউউ……আজকে সারাদিন তোমার কাছে থাকবো কি মজা৷

তনু অনু কাউকেই আজ স্কুল কলেজে যেতে দিলাম না। সবাইকে নিয়ে সারাদিন হাসি মজা করেই পার করলাম। বিকেলে অনেক্ষণ বাবার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে রইলাম। আমার পরম ভরশার জায়গা। শান্তির জায়গায়। যার দ্বিতীয় কোন তুলনা হয় না। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

বাবা- রেনু

রেনু- হুমম

বাবা- তোর কি কিছু হয়েছে রে মা???

রেনু- না বাবা

বাবা- আমাকে বলবি না???

রেনু- সত্যি কিছু হয় নি বাবা।

বাবা- সব সময় মনে রাখবি মা সমস্ত দুনিয়াও যদি তোর বিরুদ্ধে চলে যায় তোর বাবা সব সময় তোর পাশে থাকবে।

রেনু- জানি বাবা।

নিজের অজান্তেরই আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি বেয়ে পরল। বাবা বুঝে যাওয়ার আগেই মুছে ফেললাম।

মানুষ সুখে থাকলে সময় মনে হয় অনেক যলদি চলে যায়। তাই আমার সাথেও তাই হলো। আজকে দিনটা আমার জন্য অনেক সুখের ছিলো তাই হয়ত অনেক যলদি অতিবাহিত হয়ে গেছে। ঘড়ির কাটা ৮টা ছুই ছুই অবস্থা। যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছি।

মা- আসবো রেনু???

রেনু- তুমি কবে থেকে আমার অনুমতি নেয়া শুরু করলে মা।

মা- মেয়ে যখন মায়ের দায়িত্ব পালন করে তখন তো তার অনুমতি নেয়াই লাগে তাই না।

রেনু- না তোমার নেয়া লাগবে না। আসো।

বলেই মার হাত ধরে মাকে রুমে ডুকিয়ে বিছানায় বসিয়ে আমি নিচে বসে মার কোলে মাথা রাখলাম।

মা- কি করছি কি??

রেনু- একটু থাকতে দাও না মা চলেই তো যাবো।

মা- এভাবে বলছিস কেনো রে মা। কোথায় যাবি তুই???

রেনু- অফিসে যাবো আর কোথায় যাবো বলো।

মা- এমন ভাবে বললি আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

রেনু- ভয় পেয়ো না মা।

মা- তুই থাকতে আমার কিসের ভয়। একটা কথা বলবি???

রেনু- বলো মা।।

মা- তোর কি কিছু হয়েছে মা??

রেনু- কেনো মা???

মা- তোর বাবার মন টা কেমন কেমন করছে তোর জন্য আর আমারও দুদিন ধরে বাম চোখটা খুব লাফাচ্ছে। অনু তনু তো আমার চোখের সামনেই থাকে। শুধু তুই সারারাত কষ্ট করে অফিসে থাকি। একে মেয়ে মানুষ আবার করিস রাতের ডিউটি তাই মন টা কু ডাকে তোর জন্য।

রেনু- না মা চিন্তা করো না তোমার রেনু ঠিক আছে। বাবাকেও বলো আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে না।

মা আমার কপালে চুমু একে দিলেন। আমি বেরিয়ে পরলাম।।বের হওয়ার আগে বাবাকে অনুকে তুনকে একবার মন ভরে দেখে নিলাম।

অয়ন নিজেই আমাকে নিতে এসেছেন। গাড়ীতে তার সাথে তেমন একটা কথা হয় নি। শুধু জিজ্ঞেস করল বাসায় সবাই কেমন আছে বললাম ভালো আছে। আমি জানতে চাইলাম টুনি কেমন আছে সে বলল গিয়ে নিজেই দেখে নিতে। আর কোন কথা হলো না।।

বাড়িতে পৌছানোর পর থেকেই টুনি অয়ন দুজনেই ব্যস্ত কাউকেই পাচ্ছি না। কাল অয়নের জন্মদিন তাকে দেয়ার মতো কিছুই নেই আমার কাছে তাও একটা জিনিস আছে জানি না এটা পেেয় সে খুশি হবে কি না।

অয়ন আর টুনি মিলে আমার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করছে। অয়ন আমার জন্য একটা বেনারসি কিনে ছিলো। আমাকে সে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু এতো সাহসী আর বদমেজাজি মানুষটা এই টুকু কথা আমাকে বলতে পারে নি। তাই টুনি তাকে আইডিয়া দেয়। ওদের মতে আমি অয়নের জন্মদিনের কথা জানি না। তাই এই দিনেই আমাকে প্রোপজ করে চমকে দিতে বলে টুনি। টুনি তাকে বুদ্ধি দেয় প্রোপজ করে সরাসরি বিয়েটাও করে ফেলতে কারণ টুনির আর তরসইছে না কখন আমি একে বারের জন্য ওদের কাছে চলে আসবো।

অয়নের আলমারির একটা সাইডে আমার কিছু কাপড় রাখা। প্রতিদিনই আমি এসেই কাপড় পাল্টে নেই তাই কিছু কাপড়-চোপড় এখানে আছে। এগুলো সবই অয়নের কিনা। আজকেও কাপড় পাল্টানোর জন্য আলমারি খুলতেই উপরে রাখা সাদা শাড়িটাতে চোখ পরল। পাতলা একটা ঝরজেট শাড়ি। সাথে চিকেন কাপড়ের ব্লাউজ। মানুষটার পছন্দ এতো সুন্দর যে আমি নিজেই মাঝে মাঝে তাক লেগে যাই। আমি ছোট্ট করে একটা শাওয়ার দিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। চোখে মুখে কোন সাজ দিলাম। না। শুধু চুল গুলো ছেড়ে দিলাম। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

অনেক্ষণ পর সে এলেন। আমি পিছনে ঘুড়তেই দেখি সে চোখ ধাধানো অবস্থায় দাড়িয়ে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। সে যেনো তার চোখ ফেরাতে পারছে না আমার থেকে। তাকে দেখলে আমারও একি অবস্থা হয়। কিছুতেই পারি না আমি নিজের চোখ তার থেকে ফেরাতে। উনি আমার কাছে রূপবতী পুরুষ। যার রূপ আমার কাছে কোন সুন্দরী ললনার চাইতে কম নয়।

অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছে আজই শেষ বার তোমাকে এভাবে আদর করব। কাল থেকে মিসেস অয়ন চৌধুরী হিসেবে আদর করব তোমায়। শুধু আজকে রাতটাই কাল দিনেই সব পাল্টে যাবে। ছোট খালামণিটা আজ এলে আজি সব পাল্টে দিতাম। শুধু এই রাতটা অপেক্ষা করো কালকের নতুন সূর্যটার সাথে আমাদের জীবনেও নতুন গল্পের সূচনা হবে।

সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে কোলে তুলো নেয়।

অয়ন- মেরে ফেলবে বুঝি আমাকে??

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে উনার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললা।

রেনু- নাহ আজ নিজে খুন হতে চাই।

অয়ন- আমার হাতে খুন হওয়ার খুব শখ??

রেনু- খুব

অয়ন- তাই

বলতে বলতেই সে আমাকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে নিজের নিঃশ্বাসের সাথে আমার নিঃশ্বাসের মিলন ঘটালেন। তার ঠোঁটের আষ্টে-পৃষ্টে আমার ঠোঁট দুটোকে আবদ্ধ করলেন। অনেক আগেই আমি তার কাছে নিজেকে মন থেকে সপে দিয়েছি আজ আরো বেশি তার কাছে নিজেকে সপে দিতে ইচ্ছে করছে। আর তাই আজ তার সাথে আমি তার মাতাল হওয়ায় ভেসে গেলাম। তার সাথে মাতলামি করতে লাগলা। তার উন্মাদনার সাথে আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম। তাকে আমি সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে ভালোবাসা দিতে লাগলাম।

ফজরের আযান কানে আসতেই আমার ঘুম ভেংগে গেলো। আমি উঠে বসেই অয়ন কিছুটা নড়ে-চড়ে উঠল কিন্তু ঘুম ভাংলো না তার। তার কপালে একটা চুমু একে দিলাম আর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম।

রেনু- Happy Birthday my dear would be father.

টিংটিংটিংটিং

কখন থেকে এলার্মটা বেজেই যাচ্ছে কেউ বন্দ করছে না। অয়ন বালিশ থেকে মুখ না তুলেই বাম হাত দিয়ে টেবিল ঘড়িটা খুজতে থাকে আর তখনি মনে পরে টেবিল ঘড়িটা আমার পাশে রাখা থাকে সব সময়। আমি প্রতিদিন এলার্ম দিয়ে রাখি যেনো সকালে আমার দেড়ি না হয়ে যায় উঠতে তাই। অয়ন আমাকে এলার্ম বন্ধ করার জন্য বলতে হাত দিয়ে আমাকে ডাকতে নিলেই দেখে বিছানা খালি। বালিশ থেকে মাথা তুলে দেখে সত্যি বিছানা খালি আমি নেই অয়নের পাশে। অয়ন উঠে বসে দেখে রুমের কোথাও নেই আমি। আজ পর্যন্ত একদিনও এমন হয় নি অয়ন উঠে দেখেছে আমি নেই। অয়নের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। সে আমাকে খুজতে উঠে বারান্দায় যায় দেখা সেখানেও আমি নেই। পরে ভাবে ঘুম থেকে উঠে মানুষ বাথরুমে যায় বারান্দায় না এটা ভেবেই মনে মনে হেসে দেয় অয়ন। অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে কিন্তু না আমি বাথরুম থেকে বের হচ্ছি না দেখে বাথরুমের দরজায় নক দেয় তাও আমার কোন সাড়াশব্দ পায় না। বাথরুমের দরজার লক খুলতে চেষ্টা করতে নিলেই দেখে দরজা খুলে যায়। দরজাটা লক করা না। বাথরুমের ভিতরেও আমি নেই। অয়ন বুঝতে পারছে না আমি কোথায়। হয়ত নিচে গিয়েছি ভেবে নিচে নেমে আসে। এখন আমাকে না দেখে পর্যন্ত অয়নের শান্তি হবে না।

অয়ন- টুনি টুনিইই

টুনি- আসছি।

অয়নের ডাকে টুনি কিচেন থেকে দৌড়ে আসে।

টুনি- জ্বি

অয়ন- রেনু কোথায়???

টুনি হাত দিয়ে উপরে দেখিয়ে দেয়।

অয়ন- উপরে কি?? রেনু কোথায়???

টুনি- সে তো উপরে ঘুমাচ্ছে না। উঠে নি তো এখনো।

অয়ন- রেনু তো রুমে নেই।

টুনি- মানে??

অয়ন- মানে রুমে নেই তাই তো নিচে খুজতে এলাম। আমি ভাবলাম হয়ত তোর সাথে গল্প করছে।

টুনি- কিন্তু আমি তো অনেক আগে উঠেছি সে তো নিচে নামে নি।

অয়ন- নামে নি তো গেলো কোথায়??? আর রুমের দরজাটাও তো খোলা ছিলো। এলার্মটা বাজ…. ও শীট….

বলেই অয়ন আবার উপরের দিকে দৌড় দেয়। দৌড়ে রুমে এসে টেবিল ঘড়িটার নিচে রাখা কাগজটা নেয়। এলার্ম বন্ধ করার সময় অয়নের চোখে পরেছিলো কিন্তু অয়ন তখন গুরুত্ব দেয় নি। টেবিল ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অয়ন কারণ।

অয়ন- প্রতিদিন রেনু ভোর ছয় টার এলার্ম দেই আর আজ এলাম দেয়া সকাল ১০ টার। তার মানে কি রেনু ইচ্ছে করে এলার্মটা দিয়েছে????

মনে মনে এটাই ভাবছে আর বলছে অয়ন। কাগজটা খুলে দেখতে এক অজানা ভয় কাজ করছে অয়নের। যে ভয় অয়ন পাচ্ছিলো তাই হলো। এটা কোন সাধারণ ভাজ করা কাগজ নয়। এটা আমার চিঠি। অয়নকে লেখা শেষ চিঠি।

#চিঠি-

.

প্রিয়,

অয়ন চৌধুরী,

আপনার সাথে আমার একমাত্র শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক নেই। না আছে কোন নামের সম্পর্ক আর না আছে কোন মনের সম্পর্ক। আশ্চর্য হলেও সত্যি আপনার সাথে আমার কোন মনের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আমি আপনাকে আমার মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছি। শুধু মনে জায়গা নয়, আমার মনের সবটা জুড়েই আপনার বসবাস। আপনাকে কি আমার ভালোবাসা উচিত??? উচিত অনুচিত জানি না আমি শুধু এটাই জানি ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। কেনো ভালোবাসি জানি না কেবল জানি ভালোবাসি। আপনাকে কথাটা বলার সাহস হয় নি। যদি ছুড়ে ফেলেদেন। যদি ভালো না বাসেন। যদি ধিক্কার জানান আমার ভালোবাসাকে। অনেক কষ্ট পাবো হয়ত সহ্য করতে পারবো না। আপনি আমার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের সাথে পরিচিত। কখনো আপনার সামনে মাথা উচু করে দাড়াতে পারবো না। জানি আপনার কাছে আমি অনেক নিকৃষ্ট। একটা নষ্ট মেয়ে। যার আপনাকে ভালোবাসার কোন অধিকার নেই। তবু ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। কথাগুলো আপনাকে এভাবে বলছি কারণ এখন আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেও আমি জানতে পারবো না আর তাই আমার কষ্টও হবে না। আপনার জন্য আমি কি ছিলাম বা কি তা জানি না। এতোদিনে আপনার অভ্যাসে পরিণত হতে পেরেছি কি না তাও জানি না। হয়ত আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলেই আল্লাহ আমাকে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন দিয়ে দিয়েছেন যাকে আঁকড়ে ধরে আমি আমার বাকিটা জীবন পার করতে পারবো। আপনি হয়ত ভাবছেন আজ আপনার জন্ম দিন আমি তা জানি না কিন্তু না আমি জানি। আপনাকে সামনা সামনি বলি নি কারণ আপনাকে দেয়ার মতো কোন উপহার আমার কাছে নেই happy birthday. জানি না এখন যা বলবো তা আপনার জন্য বেষ্ট গিফট হবে না সব চাইতে বাজে গিফট হবে তাও বলতে খুব ইচ্ছে করছে। অয়ন, আমি মা হতে চলেছি। আপনার অনাগত সন্তান আমার গর্ভে। এটা শুনে আপনি কি বলতেন জানি না। মেনে নিতেন কি না আমার সন্তানকে তাও জানি না। যদি মেনে না নিয়ে বলতেন মেরে ফোলো। তাই পালিয়ে গেলাম। আমি পারবো না আমার ভালোবাসার চিহ্নকে শেষ করতে। জানেন গিয়েও ছিলাম একবার ওকে শেষ করতে কিন্তু পারি নি ফিরে এসেছি। এখন ওকে আঁকড়ে ধরেই বাকিটা জীবন পার করে দিবো আপনাকে ভালোবেসে। আমাকে খুজবেন কি না জানি না। খুজলেও খুজে কোন লাভ নেই কারণ রেনু হারিয়ে গেছে এই অন্ধকার দুনিয়া থেকে। এই শহরের অলি গলিতে আর খুজে পাবেন না রেনুকে। নিজের খেয়াল রাখবেন।

ভালো থাকবেন।

ভালোবাসি আপনাকে।

ইতি

আপনার রেনু।

অয়ন দাড়িয়ে থেকে বসে পরলো। অয়নের চোখের পানি দিয়ে চিঠিটা ভিজে যাচ্ছে।

তুবা আপু আমার বাসায় গিয়ে এতোক্ষণে বলে দিয়েছে আমি আর ফিরবো না। আমার শেষ দায়িত্ব হিসেবে ফ্ল্যাটের কাগজ পত্র ব্যাংক এ্যাকউন্টের ডিটেইলস সব অনুকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে সাথে অনুকে লেখা আমার চিঠিটা যেখানে অনুকে বলেছি যেনো বাবা মায়ের দিকে খেয়াল রাখে এখন থেকে সব ওকেই দেখে রাখতে হবে। আর ওদের খেয়াল রাখার জন্য একজনকে রেখে গেছি সে সব সময় ওদের পাশে থাকবে।

অয়ন- রেনুউউউউউউউউউউউউ

অয়নের চিৎকারে টুনি দৌড়ে উপরে আসে।

টুনি- কি কি হয়েছে???

অয়ন- আমার রেনু চলে গেছেরে। আমার রেনু আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছে।

টুনি- কি বলছেন যা তা।

অয়নের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে টুনি পড়তে শুরু করে।

অয়ন- আমার রেনু মা হবে টুনি আমার সন্তান আমার রেনুর গর্ভে।

অয়নের কথা শুনে টুনি চোখ বড় বড় করে তাকায়।

অয়ন- একবার যদি বলতো আমাকে কোন সারপ্রাইজ প্লেন করতাম না তখনি বলে দিতাম কতটা ভালোবাসি। একবার যদি বলতো আমাকে। একবার…

অয়ন উঠে দাড়ায়।

অয়ন- আমি কোথাও যেতে দিবো না ওকে। আমি ফিরিয়ে আনবোই ওকে। আমার ভালোবাসা আমার সন্তান কোথাও যেতে দিবো না আমি।

বলেই অয়ন পাগলের মতো দৌড়ে বেরিয়ে যায়। পাগলের মতো ড্রাইভ করে এদিক সেদিক খুজতে থাকে অয়ন তার রেনুকে। এমন কোন গলি বাকি রাখে নি অয়ন যেখানে তার রেনুকে খুজে নি। কিন্তু রেনু তো ফিরে আসার জন্য যায় নি। তাই হাজার চেষ্টা করেও অয়ন রেনুকে খুজে পেলো না। চিরকালের জন্য অয়নের জীবন থেকে রেনু হারিয়ে গেলো। সারাদিন পাগলের মতো ছন্নছাড়া হয়ে খুজে না পেয়ে রাতে ক্লান্ত হয়ে চোখ মুখ ফোলা নিয়ে বাড়ি ফিরল অয়ন। অয়নকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে অয়নের কাছে আসে টুনি।

টুনি- কি হলো??? আপনি একা কেনো??? সে কোথায়???

অয়ন অসহায়ের মতো তাকালো টুনির দিকে।

টুনি- কি হলো??? বলেন সে কোথায়??? বাসায় দিয়ে আসছেন??? সাথে নিয়ে এলেন না কেনো??

অয়ন সেখানেই মাটিতে বসে পরে।

অয়ন- হারিয়ে গেছে আমার রেনু চিরকালের জন্য। হারিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে। হারিয়ে গেছে…

অয়নের চিৎকার আর আর্তনাদ দেখে টুনিও নিজের কান্না চেপে রাখতে পারেনি।

অয়ন- নিজে বেঁচে থাকার জন্য আমার সন্তানটাকে নিয়ে গেলো কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচবো এখন?? আমি কি নিয়ে বাঁচবো???? রেনুউউউউউউউ

.

——————#সমাপ্তি।

.

এভাবেই অয়নদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় রেনুরা। #পতিতা গল্পের রেনুদের জীবনে অয়নের মতো মানুষ খুব কমই আসে হয়ত হাজার বা লাখেও একজন আসে না। কারণ বাস্তব জীবনের রেনুদের জীবনের বাস্তবতাটা গল্পের রেনুর বাস্তবতাকেও হার মানায়। কোনো রেনুরাই নিজের ইচ্ছায় বা শখের বসে #পতিতা বৃত্তি করে না। সময় আর বাস্তবতা কোনো না কোনো ভাবে তাদেরকে বাধ্য করে। কাউকে জোর করা হয় #পতিতা হওয়ার জন্য আর কেউ কেউ কোন উপায় না পেয়েই এই পথ বেছে নেয়। তবে আমি কোনো টাকেই সমর্থন করি না। শুধু তাদের জীবনের বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য আমার এই লেখা। জানি না কতোটুকু তুলে ধরতে পেরেছি তাও চেষ্টা করেছি।

আমি জানি আমার অনেক পাঠকই এই শেষ টা মানতে চাইবে না বা পারবেন না। কারণ সবাই চায় অয়ন আর রেনুর মিল হোক। তবে এটাই বাস্তবতা। বাস্তব জীবনে রেনুদের জীবনের সুখের মিলন হয় না। তাই আমি যদি বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে ওদের মিল দিতাম তাহলে তা কেবল মাত্র একটা কাল্পনিক প্রেমের গল্প হয়ে যেতো যা আমি চাই না। তাই বাস্তবতাকে অবলম্বন করে লেখাটাকে বাস্তবতার ভিত্তিতেই শেষ করলাম।

তবে এই শেষই শেষ নয় কারণ কিছু শেষ হলো নতুন কোন গল্পের সূচনা।

 

ভালো থাকবেন সবাই।

ধন্যবাদ।

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads