মায়াকথন পর্ব-১০ | Mayakathon -10 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

নিজের খুব আপন মানুষের কাছে অপমানিত হয়ে মায়া আর সাহস করতে পারেনি অন্য পরপুরুষদের ভরসা করার। পুরুষ মানুষ দেখলেই তার ভেতরে কোথাও একটা আগুন জ্বলে দাউ দাউ করে। কিন্তু এই এতশত পরপুরুষের ভীরে নওয়াজ নামক পুরুষ মানুষটাকে মায়া আজও অসম্ভব ভালোবাসে, নিজের সবটা পবিত্রতা দিয়ে ভালোবাসে। যদিও পৃথিবীর চোখে আজ সে একজন নষ্টা কিন্তু মায়া জানে তার মনটা আজও পরিশুদ্ধ। সেখানে কোনো নোংরামি বা নষ্টামি নেই। কয়েক বছর পর নওয়াজকে দেখার পর আজ সারাদিন একটা বুকভারী করা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পার করেছে মায়া। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে পার করছে সে প্রতিটা মুহূর্ত। নওয়াজময় স্মৃতি ও দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সমস্ত দিন বিছানায় গড়াগড়ি করেই পার করছে মায়া। আজ বিকাল থেকেই বৃষ্টি। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা যেন মায়ার মনের বিষন্নতাকে শতগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিষন্নতায় ভাসিয়ে দিচ্ছে।
“এই মায়া, মায়া।” দরজার বাহির থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ময়না। শুধু গলা ফাটিয়েই খ্যান্ত হচ্ছে না সে। গলা ফাটানোর সাথে সাথে হাতও চালাচ্ছে। মায়ার ঘরের দরজার উপর রীতিমতো ঝড় যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে সে। দরজা খুলে ময়নাকে দেখে মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে বিরক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কিরে এমন করতাছোছ ক্যান? ডাকাইত পড়ছে নাকি?”
“ডাকাইত পড়নের বাকিডা কী রাখছোছ হুনি? কয়ডা বাজে খেয়াল আছে?”
নিজের ছোট্ট ঘরের দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকায় মায়া। ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট চলছে। এই সময়টা তার ব্যবসার উজ্জ্বল সময়। এই সময় কখনোই মায়ার মতো ডিমান্ডিং মেয়েরা ঘরে বসে থাকে না। রমরমা কাপড় পড়ে, গাঢ় আকর্ষণীয় লিপস্টিক ঠোঁটে মাখিয়ে বেরিয়ে পরে তারা শওদা করতে।
মায়াকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে ময়না আরও বলল, “হইছে ডা কী হুনি। গতকাইলও তুই একডা কাস্টমাররে ঘরে ডুকতে দেস নাই। আইজকাও ঘরের দরজা দিয়া বইয়া আছছ? কই ব্যবসা পানি কী ছাঁদে উডাইবি নাকি? তোর কাস্টমাররা আইয়া বইয়া আছে। শালাগো কইলেও যায় না। কয় মায়ার লগে না শুইয়া যাইব না। জলদি রেডি হইয়া ল। আমি পাডাউতাছি শালাগো।” ময়না যা বলতে এসেছিল তা বলে দিয়ে মায়ার কোনো কথা না শুনেই হন হন করে হেটে চলে যায়।
এক দলা অনিচ্ছা নিয়েই মায়া আয়নার সামনে দাঁড়ায় নিজেকে তার অন্ধকার জগতের অন্ধকার রঙে রাঙিয়ে নিতে।
নওয়াজকে বুকের জমিনে দাফন করে নিজের কাজে মন দেয় মায়া। তার জন্য এখন নওয়াজের কথা ভাবা অবান্তর ছাড়া কিছুই নয়।
মায়ার সাথে রাত কাটাবে বলে অপেক্ষা করতে থাকা লোকটা লম্বা সময় অপেক্ষা করার পর ঘরে আসতেই খুদার্থ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ার উপর। মায়ার বুকের কাছের কাপড় সরিয়ে তাতে মুখ ডুবাতেই আচমকা মায়ার কী হলো কে জানে। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রে জড়ো করে নিয়ে লোকটাকে ধাক্কা লাগায় মায়া। এক ধাক্কায় লোকটা মায়ার উপর থেকে ছিটকে গিয়ে ঘরের মেঝেতে পরে। কি হলো বুঝে উঠার আগে, নিজেকে সামলে নেয়ার আগে মায়া বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের কাপড় ঠিকঠাক করে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
“এই মায়া কই যাস?” লোকটার ডাকের কোনো পাত্তা দেয় না মায়া। সে যেন শুনেও কিছু শুনতে পাচ্ছে না।

নিজের ঘরে বসে কফির কাপে চুমুক বসিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে নওয়াজ। আচমকা বাসার কলিংবেল বাজতেই একবার সময় দেখে নেয় সে। রাত ১১টার উপরে বাজে। বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময় কে হতে পারে ভাতে ভাতেই নিচে নেমে আসে নওয়াজ। দরজা খুলতেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ভিজে টইটুম্বুর হয়ে তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মায়া। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নওয়াজের। আবার মনের কোথাও খুশিও অনুভব করছে সে। কোথাও না কোথাও নওয়াজের বিশ্বাস ছিল তার মুনমুন ঠিকই তার কাছে ফিরে আসবে। হাত বাড়িয়ে নওয়াজ মায়ার ভেজা একটা হাত ধরে বলে, “মুনমুন তুমি!”
মাথা চুয়ে পানি পড়ছে মায়ার ঠোঁট বেয়ে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মায়া বলল, “ভেতরে আসতে দেবে না?” মুখে কিছু না বলে হাত ধরে টেনে মায়াকে ভেতরে নিয়ে আসে নওয়াজ। মায়ার শরীর চুয়ে পানি পড়ে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে তাদের কারোই খেয়াল নেই। নওয়াজ তাকিয়ে আছে মায়ার মুখপানে। বেশ কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলে নওয়াজের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখে মায়া। যেন তাদের দৃষ্টির ভাষায় তারা না বলা হাজার কথা বলে চলেছে। ভাগাভাগি করে নিচ্ছে অব্যক্ত হাজার অনুভূতি। নিজের জায়গা থেকে এক কদম নওয়াজের দিকে এগিয়ে এসে সে কিছু বুঝে উঠার আগে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে মায়া। অবাক হলেও নিজেকে সামলে নেয় সে। চোখ বন্ধ করে এই উষ্ণ অনুভূতি অনুভব করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নওয়াজ। হাত বাড়িয়ে আরেকটু গভীরভাবে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয় সে নিজের মুনমুনকে। তাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই মায়ার চোখ বেয়ে বহুকালের জমিয়ে রাখা কষ্ট পানি হয়ে তরতর করে গড়িয়ে পড়ে নওয়াজের বুক ভিজিয়ে দেয়। বেশ লম্বা সময় নওয়াজের বুকে থাকার পর মায়ার অশান্ত মন কিছুটা শান্ত হয়। নওয়াজকে ছেড়ে দাঁড়াতেই সে মায়াকে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসায়। আজ যেন কারো মুখেই কোনো কথা আসছে। মুনমুনকে বসিয়ে তার কোলে মাথা রাখে নওয়াজ। বেশ লম্বা সময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই বসে থাকে তারা। লম্বা বিরতির পর নওয়াজ নিজেই বলে, “আমি জানতাম তুমি ঠিক ফিরে আসবে আমার কাছে।”
“আমার ফিরে আসার সব দরজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে নওয়াজ।” মায়ার কথায় তার কোল থেকে মাথা তুলে তাকায় নওয়াজ। অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করে, “কেন?”
কিছুটা নওয়াজের কাছাকাছি ঝুঁকে তার দুই গালে হাত রেখে মায়া বলল, “তুমি বুঝতে চাইছ না কেন তোমার আমার পৃথিবীটা আর এক নেই।”
“তুমি ফিরে এসেই দেখো না আমি সব এক করে দিবো।”
“তা অসম্ভব নওয়াজ।”
“অসম্ভব বলতে কিছু নেই মুনমুন। মানুষ চাইলে সবই সম্ভব।”
“সম্ভব নয়। আমার অতীত কখনো আমার পিছু ছাড়বে না। আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না।”
“ওহো মুনমুন! আমি বলছি তো আমি সব বদলে দিবো।”
“নওয়াজ প্লিজ! তুমি বুঝতে চাইছ না কেন? তোমার সমাজ, তোমার পরিবার আমাকে তোমার পাশে কখনো মেনে নিবে না।”
“আমার সমাজ, পরিবারকে আমি দেখে নিবো। তারা মেনে না নিলে না নিবে। এই সমাজ, পরিবার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো আমি তোমাকে নিয়ে।”
“তা হয় না নওয়াজ!”
“কেন হয় না? কেন হবে না বলো? আমি সব ঠিক করতে পারলে তোমার আপত্তি কোথায়?”
“উফ নওয়াজ আমি এখানে তোমার সাথে কথা বাড়াতে আসিনি। না ঝগড়া করতে এসেছি।”
“তাহলে কেন এসেছ?”
“একটা আবদার নিয়ে এসেছি।”
“আবদার!”
“হ্যাঁ, আবদার।”
“কী!”
“তুমি কী আমাকে একবার কাছে টেনে নিতে পারো না? শুধু একবার আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে দিতে পারো না?”
“পারি। একবার নয় হাজারবার পারি। কিন্তু…”
“কিন্তু কী?” মায়ার দৃষ্টিতে অস্থিরতা। এবার নওয়াজ হাত বাড়িয়ে মায়ার গাল স্পর্শ করে বলে, “আমি চাই না আমি তোমাকে স্পর্শ করার পর অন্য কেউ আমার মুনমুনকে স্পর্শ করুক।”
সোফা ছেড়ে নিচে নেমে নওয়াজের মুখোমুখি বসে মায়া বলল, “তুমি একবার ছুঁয়েই দেখো। তারপর কেউ তোমার মুনমুনকে ছুঁয়ে দেখা তো দূরের কথা তার ছায়াটাও মাড়াতে পারবে না আমি কথা দিচ্ছি।”
নওয়াজ আর একটা কথাও বলে না। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাত মায়ার দিকে তাক করে দিতেই সে হাত ধরে মায়া উঠে দাঁড়ায়। মায়াকে কিঞ্চিৎ টানে কাছে টেনে নিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নেয় নওয়াজ। মায়ার ভিজে যাওয়া শাড়ি শরীরেই অর্ধেকটা শুকিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো মায়ার চুল চুয়ে পানি পড়ছে। নওয়াজ মায়াকে কোলে নিয়েই উপরে নিজের ঘরে চলে আসে। মায়াকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে আবার মায়ার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখে নওয়াজ। আকুতির সাথে বলে, “প্লিজ তুমি আমার সাথে চলো।”
অনেকক্ষণ ধরে নিজের ভেতর চেপে বেঁধে রাখা কান্না আর চেপে রাখতে পারে না মায়া। নওয়াজকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। মায়াকে কাঁদার সুযোগ দেয় নওয়াজ। কাঁদলে মেয়েটা হালকা হবে। হয়ত তখন নওয়াজের কথা সে বুঝতে পারবে।
নওয়াজ কোমড়ে হাত রাখতেই কেঁপে ওঠে মায়া। কাছে এগিয়ে গিয়ে মায়ার উষ্ণ ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। গভীর উষ্ণতায় মেতে উঠেছে দুজনেই। আকাশের বৃষ্টিটা যেন নিজের গতি বাড়িয়ে নিয়েছে। বাতাসে মুগ্ধতার সাথে যেন মাদকতাও ছেয়ে গেছে। সেই মাদকতায় মাতাল হচ্ছে তারা দু’জনও।

ঘুম ভাঙতেই পাশে হাত দিয়ে মায়াকে খুঁজতে নিলেই নওয়াজ বুঝতে পারে বিছানাটা খালি। তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসতেই দেখে শুধু বিছানাটা নয় ঘরটাও খালি। মায়া কোথায় দেখার জন্য উঠতে নিলেই খাটের পাশে থাকা টেবিলে রাখা চিরকুটটা নওয়াজের চোখে পরে। নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে এসে চিরকুটটা হাতে নেয় সে। চিরকুটটা খুলে পড়তেই থম ধরে যায় নওয়াজ। তার মুনমুন আবার তাকে ফেলে চলে গেছে। চিরকুটে লেখা, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও নওয়াজ আবার পালিয়ে যাচ্ছি। এবার আর ফিরে আসবো না। আমার ফিরে আসার সব রাস্তা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, যেটুকু বাকি আছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার অন্ধকার জীবনের ছায়াটাও তোমার রঙিন জীবনে পড়ুক। আমার জন্য অপেক্ষা না করে তুমি তোমার দুনিয়ায় ফিরে যাও। তবে চিন্তা করো না। তোমাকে দেয়া কথা আমি রাখবো। এই যে তুমি ছুঁয়ে দিলে এরপর কেউ তোমার মুনমুনকে ছুঁতে পারবে না। ভালো থেকো তুমি। বহুকাল বলা হয় না ভালোবাসি তোমায়।
ইতি
তোমার একান্তই তোমার মুনমুন।’
মায়ার রেখে যাওয়া চিরকুট হাতে নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে নওয়াজ। এক বুক শূন্যতা দখল নিয়েছে তার বুকের সবটা জুড়ে।

চলবে…

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads