মায়াকথন পর্ব-৯ | Mayakathon -9 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

মেয়েটা মুনমুনকে নিয়ে জমিলার কাছে এসে উপস্থিত হয়। মুনমুনকে দেখে তার চারিদিকে এক দফা চক্কর দিয়ে মুখে জমে থাকা পানের পিক পিচিত করে ফেলে দিয়ে বলে, “কিরে বিউটি এই জিনিস কই পাইলি?”
“ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নাই খালা তাই তোমার কাছে লইয়া আইলাম।”
“ক্যান! আমি কী কোনো এতিমখানা খুইল্লা বইছি নাকি কোনো ধর্মশালা চালাই যে আমার কাছে লইয়া আইছোছ। আমি ব্যবসা করি ভুইল্লা গেছোছ?”
“না খালা ভুলি নাই কিন্তু আমি জানি তুমি ছাড়া ওয় অন্য কারো হাতে পড়লে শেষ হইয়া যাইব।”
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জমিলার বুক চিড়ে। যে একদিন নিজেকেই শেষ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি সে আরেকজনকে কিই বা রক্ষা করবে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে জমিলা বলল, “আমি ফ্রি-তে কাউরে রাখি না বিউটি। আমার কাছে থাকতে হইলে ওরেও কাম করতে হইব। কাউরে দয়া করতে পারুম না আমি। দয়া করলে আমারে ভাত ছাড়া মরতে হইব অকালে।”
জমিলার কথা শুনে বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুনমুন বলল, “কিসের কাজ!” আরেক দফা তাচ্ছিল্যময় হেসে জমিলা বলল, “গতর গতর, গতরের কাম করন লাগব। এহানে যারা আছে আর যারা আহে সবাই নিজের গরত লইয়াই কাম করে। আমি কাউরে বহায় বহায় খাওয়াই না। আমার বাপ দাদার সম্পত্তি নাই।”
জমিলা আরও কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু তাকে কিছু বলতে না দিয়ে বিউটি হুড়মুড়িয়ে বলল, “খালা এলা তোমরা বুঝো কি করবা আমি গেলাম আমার ধান্দার সময় হইয়া গেছে মেলা আগে। আর দেরি করলে আমার কাস্টমাররা চিন্তায় মইরা যাইব গা আমারে না পাইয়া।” নিজের কথার বিপরীতে বিউটি জমিলাকে কিছু বলতে না দিয়ে মুনমুনের কাছাকাছি গিয়ে তার গালে আলতো ছুঁয়ে বলল, “এহানে তুই ভালোই থাকবি। আবার দেহা হইব বইন।” বইন শব্দটা শুনতেই মুনমুনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে নিজের বোন ছায়ার জন্য। না জানি সে কেমন আছে? কোথায় আছে? আর কথা বাড়ায় না বিউটি হনহন করে হেটে বেরিয়ে যায়। বিউটি বেরিয়ে যেতেই আঙ্গুলে লেগে থাকা চুন মুখে চেখে নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জমিলা মুনমুনের দিকে। তারপর হুট করেই সে মুনমুনের হাত ধরে তাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। জমিলা মুনমুনকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় মুখোমুখি বসে। সমস্ত দিনের ক্লান্তি, না খেয়ে থাকা, তৃষ্ণা, ভয়, আতংক সব একত্রে এসে ভর করেছে মুনমুনের মুখে। হয়ত এই মুখ দেখে জমিলার মতো ভয়ংকর মহিলার মনেও মায়া জন্মেছে। খাটের উপর পা তুলে বসতে বসতে জমিলা বলল, “এলা ক কী আকাম কইরা আইছোছ।” জমিলার কথা শুনে তার দিকে মুখ তুলে তাকায় মুনমুন। মুনমুনের চাহনি দেখে মৃদু হেসে জমিলা আরও বলল, “আরে ছেমড়ি এই ধান্দায় তো আজ পয়লা না। কত মাইয়া আইলো গেল এই হাতের তল দিয়া। এক একজনের এক এক ঘটনা। এহন তোর লগে কী হইছে হেইয়া ক।” একবার ঢোক গিলে থমথমে কন্ঠে মুনমুন বলল, “পানি খাবো।” জমিলা নিজের জায়গা থেকে উঠে গিয়ে এক গ্লাস বরফ দেয়া পানি এনে এগিয়ে দেয় মুনমুনকে। এক নিঃশ্বাসে পানির গ্লাসটা খালি করতেই জমিলা আরও বলল, “এলা ক।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের সাথে ঘটনা সব ঘটনা খুলে বলে। সব কথা শুনে নিজের জায়গা ছেড়ে মুনমুনের কাছাকাছি এসে তাকে নিজের বুকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে জমিলা। এমন কান্ডে অবাক হয় মুনমুন। মুখে কিছু বলতে পারে না। অবাক হলেও মনে মনে প্রশান্তি পায় সে। এতক্ষণ তার অশান্ত মনটাও কারো বুক চাইছিল যেখানে মাথা রেখে একটা শান্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পারবে সে। হয়ত এতক্ষণে মুনমুন সে জায়গাটা পেয়েছে। সবকিছু শুনে বড্ড মায়া হয় মুনমুনের জন্য জমিলার। মায়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। জমিলা নিজেও তো সখের বশে এই রাস্তায় আসেনি। সেও তো এক অন্ধকার অতীতে বাধ্য হয়েছিল এই রাস্তার আইলেন ধরে হাঁটতে। নিজের সেই অসহায় অতীতের কথা দৃষ্টি পটে ভেসে উঠতেই জমিলার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত হওয়ার পর মুনমুন বলে, “আমায় কী করতে হবে বলো।”
মুনমুনের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জমিলা বলল, “বুইঝা কইস কইলাম, একবার এই গলিতে পা বাড়াইলে কিন্তু আর কোনোদিন ফিরা আইতে পারবি না।” এবার মুনমুন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “ফিরে যাওয়ার মতো তো কোনো জায়গা নেই আমার।” মুনমুনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জমিলা বলল, “তয় আজকে থেইকা তুই মায়া।”
“মায়া!”
“হ মায়া। তোর নতুন পরিচয়। মুনমুন শেষ, আজকা থেইকা বাঁচব মায়া।”
সেদিন জমিলাই মুনমুনকে নতুন নাম দিয়েছিল, পরিচয় দিয়েছিল। সেদিন থেকে মুনমুন জমিলা খালার মায়া হয়ে রয়ে গেছে।

নিজের ভয়ংকর কালো অতীত ভাবতে ভাবতে কখন রাত শেষ হয়ে দিন হয়েছে খেয়ালই করেনি মায়া। তার ঘরের দরজায় ধুড়ামধড়াম শব্দ হতেই অতীত হাতড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসে মায়া। দু-চোখ বেয়ে পড়া পানি হাতে মুছে বিছানায় উঠে বসে সে। তখনও তার দরজায় অনবরত কেউ একজন বারি দিয়েই চলেছে। নিজের ভেতরের মুনমুনকে আবার বুকের জমিনে দাফন করে উপরের মরে, পঁচে, নষ্ট হয়ে যাওয়া মায়াকে জাগিয়ে তুলে বাজখাঁই কন্ঠে চিৎকার করে মায়া বলল, “সকাল সকাল কার উপরে ঠাডা পড়ল রে!” বলতে বলতেই বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলতেই দেখে রেগে আগুন হয়ে তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে জমিলা। সকাল সকাল এই মহিলা মানে আজ সে বোম ফাঁটাবে। অবশ্য এসবে মায়া তোয়াক্কা করে না। অন্য সব মেয়েরা জমিলাকে ভীষণ রকম ভয় করলেও মায়া ছিটেফোঁটাও ভয় পায় না। বরং জমিলা তাকে কিছু বলতে আসলে সে নিজেই তাকে পাঁচ কথা শুনিয়ে দিতে পেছন পা হয় না কখনোই।
সকাল সকাল পান চাবাতে চাবাতে এক হাত দিয়ে বুকের কাছের কাপড় ঠিক করতে করতে বাহু দিয়ে মায়াকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে জমিলা। মায়ার বিছানায় বসতে বসতে কন্ঠ সর্বোচ্চ উপরে তুলে জমিলা বলল, “কীরে মাগী সারারাইত একটা কাস্টমাররে ঘরে হান্দাইতে দেস নাই ক্যান?” এই মুহূর্তে মায়ার একদমই ইচ্ছা করছে না জমিলার মুখ লাগতে। তাই সে কোনো জবাব না দিয়ে ব্রাশ হাতে নেয় ব্রাশ করবে বলে। মায়ার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আরও চটে যায় জমিলা। কন্ঠ আরও উপরে তুলে নিয়ে বলল, “কথা কস না ক্যান? মুখে কী তোর ভাতারের ইয়া ভইরা রাখছোছ? জবাব দেস না ক্যান?”
এবার চটে গিয়ে মায়া বলল, “এই বেডি সমস্যা কী তোমার সকাল সকাল আমার মাথা খাইতে আইসে ক্যান? তোমারে কতবার কইছি না আমার লগে লাগতে আইবা না। কই নাই?”
“হেহ আমার কাছে থাইক্কা, আমার ডা খাইয়া আবার আমার লগেই গলা উডায় কথা কস তুই!” এবার হেসে দিয়ে মায়া বলল, “এতো আমার আমার যে করো তুমি নিজেই তো বাইচ্চা আছো আমার লেইগা। এই মায়া গতর বেঁচি দেইক্ষা তুমি বেডি ভাত পাও নাইলে তো তোমারে থাল লইয়া রাস্তায় বহা লাগত।” মুখে চটাং চটাং কাঠখোট্টা জবাব দিলেও মায়ার চোখ জোড়া আজ বড্ড অস্থির৷ মায়ার দৃষ্টির অস্থিরতা বুঝতে পেরে জমিলা বিছানা ছেড়ে তার কাছাকাছি এগিয়ে এসে বলল, “তোর কি হইছে রে মায়া?” জমিলার কথায় একবার মায়ার মনের গহিনে কোথাও ইচ্ছা করল তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠতে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার নিজেকে সামলে নেয় সে। এই সময়, জীবনের এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে এসব আবেগ তাকে মানায় না। তাই মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে সামলে নিয়ে কড়া কন্ঠে বলে, “কি হইব? কিছুই হয় নাই।আমার মন চায় নাই হেল্লেইগা কাউরে ঘরে হান্দাই নাই। এই বেডি, এই তোমারে আমি আগে কইছি না আমার মন না চাইলে আমি কোনো বেডার লগেই শুমু না। তাইলে এতো কথা জিগাও ক্যান তুমি? যাও তো হেনথে সকাল সকাল মাথা খাইও না আমার।” জমিলা আর কথা বাড়ায় না। মায়ার চোখ দেখেই তার মনে হচ্ছে মেয়েটার ভেতর আজ কিছু একটা চলছে। তাই সে আর তাকে ঘাটে না। আর কিছু না বলে নিজের মতো বেরিয়ে যায়। জমিলা বেরিয়ে যেতেই মায়া ধড়াম করে দরজা আটকে দিয়ে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে উন্মুক্ত করে দেয়।

চলবে…

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads