পতিতা পর্ব-২০ | Potita -20 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার বাবা পায়ের উপর পা তুলে বসে হাসছেন।

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। বাবার চেয়ারটা ধরে কেঁদেই দিলাম।

সাকিব- তুই যদি ভেংগে পরিস বাকি সবাইকে কে সামলাবে বল।

রেনু- হুমম

আমি উঠে দাড়িয়ে চোখের পানি মুছে বাবা মার রুমে ডুকলাম। আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছিলো। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে আমি কাজ শুরু করলাম। একদম প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই নিলাম না। আমাদের তিন বোনের ছোট্ট বেলার কিছু চিহ্ন যা মা ফেলতে চাইতেন না কখনো সেগুলো নিয়ে নিলাম মার জন্য। কিচেনের পিছনের স্টোর টায় রাখা যাবে৷ দুইদিন সময় থাকায় বাকি জিনিস ফ্ল্যাটেই রেখেদিলাম পরের দিন গিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করব৷ রাতের মাঝেই সব কিছুই গুছিয়ে সাকিব আমাকে হসপিটালে দিয়ে বাবাকে দেখে বাসায় চলে গেলো। পরেরদিন সকালেই বাবােক রিলিজ করে দেয়। হসপিটাল থেকে বাবাকে নতুন বাসায় নিয়ে যাই। বাবা কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি আমাকে। মা আগের দিনই তাকে বলে দিয়ে ছিলেন। বাকি সব ফার্নিচার বিক্রি করে মোটামোটি ভালো কিছু টাকা হাতে এসেছিলো। আমি মাকে বলে এক বছরের ভাড়া এক সাথে দিয়ে দিলাম। যেনো ভাড়া নিয়ে কোন সমস্যা না হয়৷ এক বেলা না খেেয় হয়ত থাকতে পারবো৷ কিন্তু মাথার উপর ছাদ না থাকলে কোথায় গিয়ে থাকবো। তার কিছুদিন পরেই আমার ফাইনাল পরীক্ষা। ভাগ্য ভালো ছিলো যে আমার ভার্সিটির সব টাকাই আগে থেকে পরিশোধ করা ছিলো। শুধু অল্প কিছু টাকা দেয়া লাগবে। টিউশনি তো ছিলোই তা দিয়েই হয়ে গিয়েছিলো। ভাবছিলাম পরীক্ষা শেষ করেই আরো কয়টা টিউশনি খুজে নিবো কোন চাকরী না পাওয়া অবদি টিউশনি করে হলেও কিছুটা হাল ধরা যাবে। ভালো মতো পরীক্ষাও দিয়ে দিলাম। পরীক্ষার সময় সাকিব আমার অনেক উপকার করেছিলো। প্রতিদিন নিজের সাথে নিয়ে যেতো আবার দিয়েও যেতো। দিন রাত পড়ে পরীক্ষা দিলাম যেনো রেজাল্টটা অনেক ভালো হয়৷ কারণ আমার যে অনেক ভালো একটা চাকরী লাগবে৷ মানুষের যখন বিপদ আসে তখন হয়ত চারিদিক থেকেই বিপদ আসে। আমার একসাথে দুইটা টিউশনিই চলে গেলো। আমি যেনো অথই সাগরে পরে গেলাম। এর মাঝে এ বাসায় তিন মাস হয়েও গিয়েছে উঠেছি। মার কাছে যা টাকা ছিলো তাও দিন দিন শেষ এর দিকে। দুই মাস পরই অনুর কলেজের ২য় বর্ষে ভর্তি৷ ভালো কলেজে পড়তে ভালো টাকাও খরচ করা লাগে। কোথায় পাবো আমি এতো টাকা একসাথে। ভেবে ছিলাম টিউশনির টাকা গুলো রেখে দিবো অনুর ভর্তির জন্য কিন্তু তা আর হলো না। আমি আবার হন্য হয়ে টিউশনি খোজা শুরু করলাম। এবারের যুদ্ধটা আরো কঠিন এবার শুধু টিউশনি না সাথে একটা চাকরীও যোগাড় করা লাগবে। অনেক ইন্টার ভিউ দিলাম অনেক। কোথাও থেকে পজেটিভ কোন খবর পাচ্ছিলাম না। আমার রেজাল্ট দেখে সবাই বলে ভালো কিন্তু জানাবে বলে আর কেউ জানচ্ছিলো না। কোন ভাবেই কোন চাকরী হচ্ছিলো না। একদিন একটা কোম্পানির রিসিপশনের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। বেতন ভালোই দিবে ১৫ হাজার টাকা সাথে পিক আর লাঞ্চও দিবে। তাই মনে মনে দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেনো চাকরীটা আমার হয়ে যায়। ইন্টারভিউ রুমে ডুকতেই যে লোকটা বসা ছিলো সে কেমনভাবে যেনো দেখছিলো আমাকে। তার দৃষ্টিভঙ্গি আমার একদম ভালো লাগেনি। তাও আমি কিছু বলি নি। ইন্টারভিউ ভালোই দিলাম। সব প্রশ্নেরই ভালো উত্তর দিয়েছি।

-আপনার তো কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।

কথাটা শুনে আমার মুখটা মলিন হয়ে গেলো।

– না না আপনি মন খারাপ করবে না। আপনি পারবেন জানি৷ আর রেজাল্ট তো আমার হাতে৷ আমি ওকে করে দিলেই হবে। আর আমার আপনাকে যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে। আপনি অনেক স্মার্ট। You are Perfect.

তার কথা গুলো আমার গায়ে পরা গায়ে পরা লাগছিলো। ইন্টারভিউতে কেই এভাবে কথা বলে জানতাম না।

– বাকিটা আপনার হাতে আপনি যদি চাকরী করতে চান তাহলে।

রেনু- স্যার আমার এই চাকরীটা খুব প্রয়োজন। আমি ঠিক সব শিখে নিবো। আর আমার বেষ্ট পারফোমেন্সটাই দেয়ার চেষ্টা করব।

ভেবেছিলাম লোকটা হয়ত ভালো হবে। আমার কথাটা বুঝবে।

– তাহলে তো হয়েই গেলো। আপনি আমার দিকটা দেখেন আমি আপনার দিকটা দেখছি।

তার কথায় আমি বেশ অবাক হই।

রেনু- আপনার দিক বলতে???

– See life is all about give and take. so আপনি আমাকে দেন আমি আপনাকে দিবো।

– আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

লোকটা কথা বলতে বলতে উঠে এসে আমার সামনে টেবিলে বসলেন। খুব বাজে ভাবে আমার কাধে হাত রাখলেন। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না লোকটা কি বুঝাতে চাইছেন বা কি চাইছেন আমার কাছে।

রেনু- আপনি চাকরীর বিনিময়ে আমার ইজ্জত চাইছেন???

– এভাবে বলছো কেনো??? আমি তো তোমার রেইপ করব না। আমরা একসাথে ইনজয় করব বেবি। আর বিনিয়মে তোমার যতো টাকা লাগে আমি তোমাকে দিবো। তখন তোমার ১৫ হাজার টাকার জন্য চাকরী করা লাগবে না। প্রতিরাতের জন্য তুমি ১৫ হাজার টাকা পাবে।

আমি লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। ধাক্কায় খেয়ে বদমাইশ লোকটা গিয়ে নিচে পরে যায়। কিছু পরার শব্দে পেয়ে অনেকেই ভিতরে চলে আসে। আমি উঠে গিয়ে লোকটার সামনে দাড়াই।

রেনু- তোদের মতো বেজন্মাদের জন্যই মেয়েরা আজো ঘরের বাইরে সুরক্ষিত নয়। আমি মান-সম্মানের সাথে চাকরী করে হালাল উপার্জন করতে এসেছিলাম নিজেকে বিক্রি করতে নয়।

রাগে আর কষ্টে আমি কথাই বলতে পারছিলাম না। ঐ অমানুষটার মুখে থুথু দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

রাস্তায় বেরিয়েই কেঁদে দিয়েছিলাম মেয়ে বলে একজন মানুষ নামের অমানুষ আমার মান-সম্মানে হাত দিতে চাইছিলো। আমি কি কিছুই করতে পারবো না আমার পরিবারের জন্য। আল্লাহ কবে আমাদের মুখের দিকে তাকাবেন। কবে আমাদের দুঃখ গুলোকে একটু কমিয়ে দিবে। আমি অনেক কিছু চাই না শুধু আমার পরিবারকে নিয়ে দুবেলা ঠিক মতো খেয়ে পরে ভালো থাকতে চাই আর কিছু না। কান্না করেই আমার চোখ মুখ ফুলে গেছে। অনেকটা পথ হেটে এসেছি। শরীর আর সঙ্গ দিতে পারছিলো না৷ তাও আমি নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। হুট করেই পথে আমার তুবা আপুর সাথে দেখা হয়। সে আমাকে দেখে একপ্রকার দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। আমি তুবা আপুকে পেয়ে আবার কেঁদে দিলাম৷ আমার কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করতে পেরে আপু আমাকে নিজের সাথে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমাকে শান্ত করে খাওয়া দাওয়া করান তারপর আপু আর আমি চা নিয়ে বসি। সেদিন সকালে ঘটে যাও সব কথা আপুকে বললাম। আপু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

তুবা- দুনিয়াটা হারামিরে রেনু। তুই পারবি না এদের সাথে। পথে পথে এমন সব জানোয়ার দিয়ে ভরা। ওরা মেয়ে দেখলেই খাবলে খেতে চায়।

রেনু- আমার একটা চাকরী খুব দরকার আপু তোমার তো এতো মানুষের সাথে পরিচয় দেখো না আপু কিছু একটা করতে পারো কি না।

তুবা- তারা আমার কাছে নিজের প্রয়োজনে আসে রে। প্রয়োজন মিটিয়ে চলে যায়। আমার কথা শুনতে আসে না।

আপুর জন্য শুরু থেকেই আমার অনেক কষ্ট হতো। তুবা আপু আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের পাশের বিল্ডিং এ থাকতো। তার সাথে প্রায় আমার ছাদেই দেখা হতো। তাকে প্রায় সময় আমি নানারকম ছেলের সাথে দেখতাম প্রথম প্রথম ভাবতাম তারা হয়ত আপুর বন্ধু কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল তারা আপুর বন্ধু নয়। এক দিন কৌতুহলের বশেই আপুকে জিজ্ঞেস করে ফেলি তখন আপু বলেছিলো। ছোট বেলায় চাচা-চাচীর কাছে মানুষ হয়েছিলো। আপুর বাবা-মা অনেক ছোট থাকতেই মারা যায়। অনেক কষ্টে নিজের পড়া লেখা চালিয়েছেন। মাস্টার্সটাও কমপ্লিট করেছিলেন। কিন্তু কোথাও চাকরী পাননি৷ অবশেষে একটা চাকরী পেয়েও জান কিন্তু জয়েনের কিছুদিন পরেই তুবা আপু আমার মতোই বাজে একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়৷ তবে আমি নিজের সম্মান নিয়ে ফিরে আসতে পারলেও তুবা আপু পারে নি নিজের সম্মান নিয়ে ফিরে আসতে সেদিন। তুবা আপুকে সেদিন নিজের সম্মান হারাতে হয়েছিলো মানুষ রূপি কোন অমানুষের হাতে। ঐ ঘটনার পর আপু আর চাকরী করে নি কোথাও। আপু বলেছিলো চারি দিকে সব শিয়াল-শকুন এদেরকে না দিলে এরা জোর করে খাবে। তারপর আপু নিজেই ঐ লাইনে চলে যায়। যখন প্রয়োজন হয় যায় না হয় তো যায় না। আপুর কাধে তো কোন দায়িত্ব ছিলো না। তার জীবন শুধু নিজেকে নিয়েই। আপুর জীবনের কষ্টগুলোর কথা শুনার পর থেকেই তার প্রতি আমার মায়াটা যেনো অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। আমি কখনো তাকে খারাপ ভাবে দেখি নি। সে কি করে সেটা আমার জন্য মূখ্য নয় আমার জন্য সে আমার তুবা আপু। তবে এটাও জানি যেই আপুর আসল সত্যটা শুনবে সেই আপুকে ঘৃণা করবে। জানি না কেনো আমি আপুকে ঘৃণা করতে পারতাম না।

আমি সারা বিকেল আপুর সাথে কাটিয়ে উঠে পরলাম বাসায় যাওয়ার জন্য।

রেনু- আপু আজ যাই৷ বেশি দেড়ি হয়ে গেলে আবার মা চিন্তা করবে।

তুবা- সাবধানে যাস।

আপু আমার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে দিলেন। আমি নিষেধ করাতে আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।

তুবা- রেনু শুন

রেনু- হ্যাঁ আপু বলো।

তুবা- আশেপাশে যাকেই দেখবি কখনো ভরসা করবি না৷ সব গুলো পশু। একটাও মানুষ না। মানুষ রূপে জানোয়ার সব৷ কখনো জোর করে কাউকে নিতে দিস না।

আমি বাসায় চলে এলাম। মাকে কিছুই বলি নি। তুবা আপু ছাড়া কাউকেই বলি নি।

কোন ভাবে একটা চাকরী যোগাড় করতে পারছিলাম না৷ ঐ দিকে অনুর ভর্তির সময় ঘনিয়ে আসছিলো৷ আমার মাথা কোন ভাবেই কাজ করছিলো না। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে আমার ল্যাপটপ টা বিক্রি করে দিয়ে অনুকে ভর্তি করালাম। কিন্তু আমার বিপদের তো সেখানেই শেষ না। মার হাতে যা ছিলো সব শেষ৷ তখন কোন ব্যবস্থা করতে না পারলে কয়দিন পর থেকে ঘরে আর চুলা জ্বলবে না। বাবার ঔষধ। অনু তনুর পড়ার খরচ। সারারাত ছাদে পায়চারি করলাম কোনো দিক দেখতে পাচ্ছি না আমি। যেখানেই যাই কেউ আমাকে চাকরী দিতে চায় না উল্টো আমার সম্মান কেড়ে নিতে চায়। আর কিছু চিন্তাও করতে পারছি না। কারো সাথে কথা বলা দরকার। এতো রাতে তমাকে ফোন দেয়া ঠিক হবে না। তমা ওর হাজবেন্ডের সাথে থাকে। তাই তুবা আপুকেই ফোন দিলাম।

তুবা- কিরে এতো রাতে তুই??

রেনু- আপু রে একটা চাকরী যে আমার খুব দরকার।

তুবা- আমি দেখছি কি করা যায়।

মাঝে আরো দিন দশেক চলে গেলো কোন লাভ হলো না। আমি আবার একি পরিস্থিতির শিকার হলাম। ভাগ্যে কি আছে জানি না ২য় বারো আমি মান-সম্মান নিয়েই ফিরে এলাম। তবে এবার আর কাঁদি নি৷ শুধু ভেবেছি৷ আমার হয়ত আর মাস্টার্সটা করা হবে না। আর অনার্সের সার্টিফিকেট কেউ হয়ত চাকরীও দিবে না আর যদি কেউ দেয় তাহলে তা দিবে আমার এই শরীরটার জন্য আমার যোগ্যতার জন্য নয়। আমি বাসায় ফিরে দেখলাম সবাই চুপচাপ কেউ আমাকে কিছু বলছে না। মাকে জিজ্ঞেস করতে সে মুখ চেপে কাঁন্না করছেন। অনুও কিছু বলছে না। শেষে তনুটার মুখ থেকে বের করলাম। ঘরে কিছু নেই তাই সকাল থেকে সবাই না খেয়ে আছে। কথাটা শুনে আমার যেনো কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিলো। আমার ব্যাগে সামান্য কিছু টাকা ছিলো আমি দৌড়ে গিয়ে গলির মোড়ের দোকান থেকে ১ কেজি চাল আর ৪ টা ডিম কিনে নিয়ে এলাম। আমার অনু তনুকে রান্না করে খাওয়ালাম। বাবা মাকে খাওয়ালাম। সবাইকে ঘুম পারিয়ে আমি ছাদে চলে গেলাম। আমার ভেতরটা হাহাকার করছে। আল্লাহ আমাকে এমন দিনের সম্মুখীন করবেন কখনো ভাবতেও পারি নি৷ না পারছি মরে যেতে না পারছি বেঁচে থাকতে। আমি তুবা আপুকে ফোন দিলাম।

রেনু- আপু আমি কাজ করব।

তুবা- কোনো চাকরী হলো???

রেনু- চাকরী হবে না আপু। কেউ দিবে না চাকরী।

তুবা- তাহলে কি করবি???

রেনু- কেউ জোর করে নিলে তো আর তার বিনিময়ে কিছু পাবো না এর চাইতে আমারটা আমি নিজেই কাজে লাগাই।

তুবা- তোর কি মাথা ঠিক আছে??? কি বলছিস তুই এসব??? এটা কোন জীবন নয়। এটা নরক। মৃত্যুর পরেও এর শাস্তি ভোগ করা লাগবে।

রেনু- আমি সেটার জন্যও প্রস্তুত আপু। আমার কিছু করার নেই৷ কোন পথ খোলা নেই আমার কাছে। আজ ঘরে চুলা জ্বলে নি। আমার অনু তনু না খেয়ে দিন পার করেছে। আমার অসুস্থ বাবার মুখে ভাত ঝুটে নি সারাদিন। ওদের যদি না খাইয়েই রাখতে হয় তাহলে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি আপু বলো।

তুবা- এতো কষ্ট করেছিস আরেকটু দেখ বোন। এভাবে নিজেকে নরকে ঠেলে দিবি??

রেনু- অনেক দেখেছি আপু আর সম্ভব না। নিজেকে নরকে ঠেলে দিয়ে যদি মানুষ গুলোকে ভালো রাখতে পারি তাহলে আমার আর কিছুই চাই না।

তুবা- তুই তাও ভাব আরো।

রেনু- আমার ভাবা শেষ আপু। তুমি ব্যবস্থা করো।

তুবা আপুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ফোনটা রেখে দিলাম। আপু দুবার কলও দিলো আমি ধরলাম না। জানতাম আপু আমাকে বুঝাবে তবে এই বুঝ দিয়ে আমার সংসারের চুলা জ্বলবে না। আমার অসুস্থ বাবার ঔষধ আসবে না। আমাদের বোনদের লেখাপড়া হবে না। সারারাত আমি ঘুমাই নি৷ পরের দিন আবার আপুকে ফোন দিলাম।

রেনু- কোন ব্যবস্থা হয়েছে???

তুবা- তুই সত্যি সত্যি নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিস।

রেনু- হ্যাঁ।

আপু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন আমি শুনতে পেলাম।

তুবা- আমি তোকে কিছুক্ষণ পরে ফোন দিচ্ছি।

ফোন রাখার ঘন্টা খানেক পরই আপু আমাকে আবার কল দেয়।

রেনু- হ্যাঁ বলো।

তুবা- আমি তোকে একটা ঠিকানা এসএমএস করে দিচ্ছি ৮ টা নাগাদ সেখানে চলে যাবি৷ একজন আসবে গাড়ি নিয়ে ডিটেইলস লিখে দিচ্ছি। তোকে নিয়ে যাবে সাথে সকালে আবার পৌঁছে দিয়ে যাবে।

রেনু- ঠিক আছে।

তুবা- তার নাম …

রেনু- নাম জানা লাগবে না আপু। অন্ধকার অন্ধকারই। অন্ধকারের কোন নাম হয় না। কোন ব্যাখ্যা হয় না।

তুবা- ঠিক আছে।

রেনু- রাখছি।

তুবা- শুন

রেনু- বলো

তুবা- শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যদি তোর মনে হয় তুই এই কাজ করবি না। তাহলে কিছু করা লাগবে না। আমাকে শুধু একটা ফোন দিলেই হবে আমি সব সামলে নিবো। একবার এই পথে হাটলে তুই ছাড়তে চাইলেও এই অন্ধকার জগৎ তোকে ছাড়বে না।

রেনু- হুম….

মাকে গিয়ে বললা আমার চাকরী হয়ে গেছে। মা শুনে যে কি খুশি৷ কিন্তু আমি জানি আমি জীবনে প্রথম আমার মাকে মিথ্যে বলছি।

মা- কিসের চাকরী???

রেনু- মনে আছে গত মাসে একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির কল সেন্টারের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। ওরা জানাবে বলে আর জানায় নি৷ ওরাই ফোন দিয়ে বলল আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। আমি চাকরীটা পেয়ে গেছি মা।

মা- কিন্তু তুই না বললি রাতের শিফট।

রেনু- হ্যাঁ, মা তবে আমি একা নই। আরো অনেক মেয়েরাই রাতে কাজ করে।

মা- কিন্তু….

রেনু- আর কোন কিন্তু বলো না মা অনেক কষ্টে চাকরীটা পেয়েছি। ২০ হাজার টাকা সেলারি দিবে। সাথে টার্গেটের উপর বোনাস হ্যনতেন অনেক কিছু আছে। এর চাইতে ভালো চাকরী এখন আর পাবো না মা।

মা আমার কাপালে একটা চুমু দিয়ে দিলেন।

তারপর রাতে আপনি এলেন আমাকে নিতে। বাকিটা আপনার জানা৷ সেখান থেকে শুরু হয় আমার অন্ধকার জগৎ এর অন্ধকার গলিতে পথ চলা।

আমি এক নাগাড়ে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছু বললে ফেললাম। চোখের পানি নাকের পানি কখন যে এক হয়ে গেছে আমি জানিও না। তার সামনে নিজেকে অনেক তুচ্ছ, নঘন্ন মনে হচ্ছে। তার দৃষ্টি আমাতে স্থির। মনে হয় যেনো সে পলকও ফেলছেন না। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ সে আমার চোখের এক ফোঁটা পানিও মাটিতে পরতে দেন নি৷ সে হাত পেতে রয়েছেন আর আমার চোখের পানি তার হাতে গিয়ে জমছে। সে তার ভেজা হাত দিয়ে আমাকে ধরলেন। তার হাত আমার গালে রেখে তার ঠোঁটের স্পর্শে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন। আমি পিছন ফিরে চলে আসতে চার কদম সামনে যেতেই সে দ্রুত গতিতে এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন।

অয়ন- আজ থেকে তোমার অন্ধকার জগৎটা কেবল আমার বুকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তোমার অন্ধকার জগৎ এর অন্ধকার সম্পর্কে কেউ জানবে না কখনো।

আমি পিছন ঘুড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। নক দিয়ে তার শার্ট খামচে ধরে তার বুক ভিজাতে লাগলাম।

.

চলবে…….

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads