মায়াকথন পর্ব-১১ | Mayakathon -11 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

সারারাত নওয়াজের ঘুম হয়নি। বুকের ভেতর কেমন একটা তোলপাড় চলেছে। সকালে তার কানাডা ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট। মুনমুনকে পাওয়ার পর ভেবেছিল তাকে হয়ত একা ফিরতে হবে না। কিন্তু এবারও তাকে শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে। তবে এবারই হয়ত শেষবার। এরপর কী তার আর দেখা হবে মুনমুনের সাথে? এই ছোট্ট পৃথিবীতে চলার পথে আবার কী তারা হবে একে অপরের মুখোমুখি। একবুক ভার করা দীর্ঘশ্বাস নিয়েই রেডি হয় নওয়াজ এয়ারপোর্ট যাবে বলে। তার ফ্লাইট দুপুর ১ টায়। এখন বাজে সকাল ৭ টা। এখানে তার আর কিছুই নেই তাই চিন্তা করে সকাল সকালই বেরিয়ে যাবে। ফ্লাইটের আগের বাকিটা সময় এয়ারপোর্টে বসেই কাটিয়ে দিবে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে চলে তো যাচ্ছে সে কিন্তু মন তার এখনো তাকে সায় দিচ্ছে না চলে যেতে।

কারো হৈচৈ-এ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে জমিলা। বেরিয়ে আসতেই দেখে একটা বাচ্চা ছেলেকে ঘিরে রয়েছে মেয়েরা। ছেলেটা ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে। তার চোখে কৌতুহলের পাশাপাশি কারো খোঁজ। কাছাকাছি এগিয়ে এসে জমিলা বলল, “কীরে এতো চিল্লাচিল্লি কিয়ের? কিরে রাহেলা এইডা হেনে কী করে?”
জবাবে রাহেলা বলল, “মায়ার কাছে আইছে।”
“মায়ার কাছে কী চায়?” বলেই জমিলা ছেলেটার আপাদমস্তক একবার দেখে নেয়। এবার ছেলেটা মুখ খুলে বলল, “মায়াবু রে একটু ডাইক্কা দ্যান না।” জমিলা আরেক কদম কাছাকাছি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “মায়ারে দিয়া তোর কী কাম? নাম কী তোর?”
“মিম। মায়াবুর কাছে ভাত খাইতে আইছি।”
“ভাত!”
“হো ভাত। মায়াবু কইছে খিদা লাগলে হের কাছে আইতে। হেয় আমারে ভাত খাওয়াইব।”
জমিলা মিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রাহেলাকে বলল, “ঐ রাহেলা মায়ায় কই?”
“কইতে পারি না খালা। সকাল থেইকা দেহি নাই ওরে। ময়না গেছে ওর ঘরে ডাকতে।”
“আইচ্ছা, আমি গেলাম।”
জমিলা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দৌড়ে আসে ময়না। দৌড়ে আসতে গিয়ে জমিলার সাথে ধাক্কা লাগে ময়নার। তাল সামলাতে না পেরে পেছনের দিকে পড়ে যেতে নিলে পেছন থেকে আরেকজন ধরে ফেলে তাকে। গলার আওয়াজ চওড়া করে চেঁচিয়ে উঠে জমিলা বলল, “আলো মাগীর ঘরের মাগী সকাল সকাল কী চোখের মাথা খাইছছ। খানকি তোর নাগড়ে কী দৌড়ানি দিছে তরে?” জমিলার ধমক খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ময়না বলল, “খালা মায়া।”
“কি হইছে মায়ার!”
“মায়া দরজা খোলে না। অনেক ডাকছি তাও খোলে না।”
“ঘুমাইতাছে মনে হয়।”
“কাইল রাইতেও ওয় ঘরে কোনো কাস্টমার হান্দায় নাই। রাইত্তের পর কেউ ওরে দেহে নাই। আমার ডর করতাছে খালা।”
“ডর করনের কি আছে। মাগীডায় মনে হয় নাকে শইষার তেল দিয়া ঘুমাইতাছে আমার ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বালাইয়া। আজকা ওর একদিন কি আমার একদিন। মাগীডারে ছিইল্লা লবণ লাগায় না দিছি যদি আমিও জমিলা না তাইলে একটা ভুসকি। কিছু কই না দেইখা অনেক বাড় বাড়ছে ওর। আজকা ওরে আমি শ্যাষ কইরালামু।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মায়ার ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হয় জমিলা। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দরজা ধাক্কায় কিন্তু এতেও বিশেষ লাভ হয় না। না তো মায়া সাড়া দিচ্ছে আর না দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে।
“ওই মায়া দরজা খুল কইলাম। দেখ আমারে আর রাগাইস না। আলো মাগীরে দরজাডা খুল।” পাশ থেকে রাহেলা বলল, “খালা অনেক সময় হইয়া গেছে। এলা আমারও কিছু ভালা ঠেকতাছে না। তুমি দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করো। আর দেরি করন মনে হয় ঠিক হইব না।
এবার জমিলার নিজেরও কিছুটা চিন্তা হয়। তারও মনে হচ্ছে কোথাও কোনো একটা গন্ডগোল আছে। জমিলা চেঁচিয়ে বলল, “এই ময়না শিগগির রহিমরে ডাক দে। দরজা ভাঙন লাগবো।”

নওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ রোডের সেই নষ্ট গলির মোড়ে। এই গলির শেষ মাথায় সমাজ থেকে পরিত্যক্ত বাড়িটাতেই আছে তার মুনমুন, মায়া রূপে। মুনমুন নিষেধ করেছিল বলেই আগে সে এখানে আসেনি। কিন্তু আজ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি সে। আরও একবার চেষ্টা করতে চায় সে তার মুনমুনকে ফিরে পাওয়ার। আরও একবার চেষ্টা করতে চায় সে তার মুনমুনকে বুঝানোর, ফিরিয়ে আনার। তাই মুনমুনের দেয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সে এসে উপস্থিত হয়েছে মায়ার দুয়ারে তার মুনমুনকে ভিক্ষা চাইতে।
কদম যতই সামনের দিকে যাচ্ছে ততই অজানা কোনো সংকায় বুকের ভেতরটা ডিপ ডিপ করছে নওয়াজের। কেমন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে গলার কাছে তার দমটা বারবার আটকে আছে। হঠাৎ কেন এমন অনুভব করছে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না নওয়াজ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে বারবার। বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে চিৎকার, চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসতেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে নওয়াজের। পা জোড়া যেন আর সামনে যেতে চাচ্ছে না তার। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে কদম বাড়ায় সে। বাড়ির ভেতর থেকে আসা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ অনুসরণ করে মায়ার ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হয় নওয়াজ। মানুষের ভীরের জন্য বাহির থেকে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না ভেতরে কি হয়েছে বা হচ্ছে। ভীর ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই একবার বেতাল হয়ে পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয় নওয়াজ। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার কদম বাড়ায় সে। এগিয়ে গিয়ে মায়ার বিছানার একটা কোন ঘেষে বসে। ঘরের অনেকেরই দৃষ্টি এখন এই অজানা মানুষটার দিকে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নওয়াজ তার মুনমুনের নিথর দেহটার দিকে। ভীষণ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। যে ঘুমের কোনো সমাপ্তি নেই সেই ঘুম ঘুমাচ্ছে নওয়াজের মুনমুন। হাসিহাসি মুখ করে ঘুমিয়ে আছে মায়া। যেন তার কোনো দুঃখ নেই। নেই কোনো আক্ষেপ বা না পাওয়া। হয়ত তার সব পাওয়া হয়ে গেছে। কি ভীষণ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে নওয়াজের মায়া মরণ ঘুম।
“আলো মাগীরে মাগী এইডা তুই কি করলি? তুই কি ভুল্লা গেছছ জমিলায় তোরে জবান দিছিল তুই চাইলে আমি তোরে মুক্ত কইরা দিমু। আমারে না কইয়া এমন মুক্তি ক্যান লইলি তুই? মায়া রে…” ঘরের মেঝেতে বসে পাগলের মতো প্রলাপ বকছে জমিলা। আজ পর্যন্ত কোনো বেশ্যার জন্য কেউ কেঁদেছে কিনা কে জানে? তবে জমিলা কাঁদছে। মায়ার জন্য খুব কাঁদছে সে। প্রলাপ বকে বকে, বুক চাপড়ে কাঁদছে জমিলা। তার সঙ্গে কাঁদছে অন্যরা সবাই।
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে মিম৷ এখনও হয়ত সবটা বুঝে উঠতে পারছে না সে। মায়ার মুখের কাছে গিয়ে মিম তাকে আলতো ছুঁয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, “মায়াবু আমি আইছি। অনেক খিদা লাগছে। তুমি না কইছ খিদা লাগলে তোমার কাছে আইতে, তুমি আমারে ভাত দিবা। মায়াবু, ও মায়াবু ভাত দিবানা?”
সবার মাঝে চুপচাপ নিঃশব্দে বসে আছে নওয়াজ। তার ভেতরের অস্তিত্বরতা, অস্বস্তিটা এখন থেমে গেছে। এখন সে বুঝতে পারছে কেন সারাটারাত সে ছটফট করেছে। এখন সব পরিষ্কার তার কাছে। এখন সে বুঝতে পারছে মুনমুনের লিখে রেখে যাওয়া সেই চিরকুটের মানে। নওয়াজের সাথে যাওয়ার চাইতে হয়ত বিষ খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়াটা মায়ার কাছে সহজ মনে হয়েছে। মায়ার আর কিই বা করার ছিল। আমাদের সমাজটাই এমন। এই সমাজ মায়াদের মেনে নেয় না। এই সমাজ নিজেদের সভ্য সমাজে মায়াদের স্থান দেয় না। এই সমাজের জন্যই মায়ারা পারে না তাদের অতীত ভুলে ভবিষ্যতের নতুন স্বপ্ন বুনতে। অথচ এই সমাজ এটা ভুলে যায় মায়াদের জন্মই হয় এই সমাজের সভ্যতার মুখোশ পড়ে থাকা কিছু মানুষ রূপী জানোয়ারের জন্য।
বিষের শিশিটা এখনো মায়ার হাতের মুঠোয় রয়েছে। নিজের জায়গা থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে মায়ার মুখটাকে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেয় নওয়াজ পরম যত্নে, ভালোবাসায়। এই ছোঁয়াই শেষ ছোঁয়া তার ভালোবাসাকে ভালোবেসে।

পরিশিষ্ট
“এখানে কে আছে বাবা?” নওয়াজকে প্রশ্ন করে তার ছোট মেয়ে মায়া। নওয়াজ মায়ার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে তার বড় মেয়ে মুনমুন জিজ্ঞেস করে, “এটা কার কবর বাবা? আমরা এখানে কেন এসেছি?” নওয়াজ তার দুই মেয়ে মুনমুন ও মায়াকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে। এখানে মুনমুনের বাবা-মাকে কবর দেয়া হয়েছিল। তাই সে তার প্রিয়তমাকে এখানেই দাফন করেছে। হয়ত মায়ারও এটাই ইচ্ছা ছিল। প্রতিমাসেই সে অন্তত একবার হলেও এখানে আসে মায়ার সাথে দেখা করতে। নওয়াজের স্ত্রী তুলির কোনো আপত্তি নেই এতে যে তার স্বামী তার প্রাক্তন প্রেমিকার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে। বরং সে বুঝে তার স্বামীকে। সম্মান করে তার ভালোবাসার। মেয়েরা সবসময় জানতে চায় সে কোথায় যায় তাই আট বছরে আজ প্রথম নওয়াজ তার মেয়েদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে দেখা করাতে।
হাসি হাসি মুখ করে মায়ার কবরের দিকে তাকিয়ে নওয়াজ বলল, “তোমরা সবসময় জানতে চাও না আমি কাকে বেশি ভালোবাসি। এখানে যে মানুষটা ঘুমিয়ে আছে আমি তাকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসি।”
মুনমুন বলল, “আম্মুর চাইতেও বেশি ভালোবাসো?”
“হ্যাঁ তোমার আম্মুর চাইতেও বেশি।”
নওয়াজের হাত ছেড়ে মায়া গুটি গুটি পায়ে আরও দুই কদম এগিয়ে যায় কবরের কাছাকাছি। কবরটাকে ভালো মতো দেখে পেছন ফিরে বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমাদের চাইতেও বেশি ভালোবাসো বাবা?”
“হ্যাঁ মা, তোমাদের চাইতেও বেশি। পৃথিবীর সব কিছুর চাইতে তোমাদের বাবা এই মানুষটাকে বেশি ভালোবাসে।”
“তাহলে তোমার ভালোবাসা মরে গেল কেন বাবা?”
“হয়ত তার তোমার বাবার ভালোবাসা চাই না তাই সে তোমাদের বাবাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।”
নওয়াজের কথায় তার ছোট্ট মেয়ে দুইটা কি বুঝল কে জানে। তারা বাবার কাছে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি দুঃখ পেও না বাবা। আমরা কখনো তোমাকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও যাবো না। আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসবো বাবা। তোমার ভালোবাসার চাইতেও বেশি ভালোবাসবো।”
মেয়েদের আলতো করো বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে নওয়াজ বলল, “এই মানুষটার চাইতে কেউ আমাকে বেশি ভালোবাসতে পারবে না মা।”

সমাপ্তি।

Related Posts

Leave a Comment

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker

Refresh Page