পতিতা পর্ব-৬ | Potita – লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

আমি ঐ টুকু মানুষ কিই বা বলতাম। পা টিপেটিপে মায়ের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরল। টুনি- তারপর কয়েকদিন বাবাকে দেখিনি। কোথায় ছিলো জানি না৷ আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম “মা বাজান কই গেছে আহে না কেলেইগা??? আমার পরানডা বাজানের লেইগা কেমন কেমন করে মা।” মা আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদে।

টুনির মা- জানি না রে মা তোর বাপে কই গেছে। আমার কপাল পুড়ছেরে মা আমার কপাল পুড়ছে।

টুনি- ঐ সময় বুঝিনি কপাল পুড়া জিনিসটা কি। তখন বুঝিনি আমার মার কপাল কিভাবে পুড়ল। আমি মার কাপলে তাকিয়ে দেখলাম মার কপালে তো কোন পোড়া দাগ নেই তাহলে মা কেনো বলল তার কপাল পুড়েছে। ঐ সময় ব্যাখ্যা চাওয়ার চাইতে আমার মায়ের চোখের পানি মুছে দেয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিলো তাই আর মার কাছে জানতে চাই নি “মা মাগো কপাল পুড়া কি জিনিস।” তার কিছু দিন পর বাবা আসলো। বাবাকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে৷ তখন এতো কিছু আমি বুঝি না। আমি তো আমার বাবাকে দেখেই খুশি হয়ে চিৎকার করে উঠলাম “মা বাজান আইছেএএএ” চিৎকার করতে করতেই বাবার কাছে দৌড়ে গেলাম। বাবা আমাকে কোলে তুলে চুমু খেলেন। মা কলপাড়ে পানি তুলছিলেন৷ কলস ফেলে মাও দৌড়ে এসে দাওয়ায় দাড়ায়। বাবা কাছাকাছি আসতেই বলে উঠলেন।

টুনি মা- আপনে আইছেন?? আহারে চোখ-মুখ খান হুগায় গেছে। আপনে কলপাড়ে জান আমি আপনের লাইগা গামছা লইয়া আহি৷ গোসল দিয়া গরম ভাত খাইবেন৷

টুনি- তারপরের কয়টা দিন বাবাকে মার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করতে দেখি নি৷ আর ঝগড়াও করতে দেখিনি৷

তার পর একদিন।

-মফিজ মিয়া বাড়ি আছো নি?? ওওও মফিজ মিয়া বাড়ি আছো নি???

টুনির বাবা- কেডারে ডাকে???

-আরে মিয়া আমি জব্বার আলী।

মফিজ- আরে জব্বার মিয়া যে। আহো মিয়া বাড়ির ভিত্তে আহো। ও টুনির মা কই গেলা। জব্বার মিয়ার লাইগা দানা পানির ব্যবস্থা করো।

জব্বার- না না দানা পানি অন্যদিন হইবো। আজকে একটা দরকারি কামে আইছি।

মফিজ- কি কাম কও মিয়া???

জব্বার আলী ফিসফিস করে বাবাকে বলল।

জব্বার- একদল বড় পার্টি আইছে।

টুনি- কথাটা বলেই তারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চায়ি করে। আমি পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম।

জব্বার- এদিক আহো…

টুনি- জব্বার কাকা বাবাকে সাইডে নিয়ে গিয়ে কি কি যেনো বলল৷ বাবা তাকে বিদায় করে দিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘরে গেলেন।

মফিজ- ও টুনির মা টুনির মা ট্যারাংকের চাবিডা দেও তো।

টুনি- বাবার যেনো তর সইছিলো না। মা রান্নায় ব্যস্ত ছিলো। বাবা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসে মার আঁচল থেকে চাবিটা নিয়ে আবার ঘরে যায়। শুধু ট্রাং খুলার খট করে শব্দ পেলাম৷ কি করলো কিছুই জানি না। মাকে চাবি টা দিয়ে একটু কাজ আছে বলে বাবা চলে গেলো। মা পিছন থেকে চিৎকার করতে লাগল।

টুনির মা- আপনে খাইবেন নাআআআআ…

মফিজ- রাইত্তে আইয়া খামুউউউউ

টুনি- সেদিন অনেক রাতে বাবা বাড়ি ফেরে। বাবার মুখ-চোখ কেমন যেনো লাগছে দেখতে৷ বাবাকে দেখেই মা আমাকে বলল।

টুনির মা- মা যাও দাদির লগে গিয়ে ঘুমায় পরো।

টুনি- আমি বের হতে হতে শুনলাম।

টুনির মা- আপনাকে হাত মুখ ধুইয়া আহেন। আমি ভাত বারি আপনের লাইগা।

মফিজ- না ভাত খামু না।

টুনির মা- কেন খাইয়বেন না??? কি হইছে আপনার।

মফিজ- খামু না কইছি খামুনা এতো প্রশ্ন করোছ কেন???

টুনি- আমি দাদির কাছে চলে এলাম। তাও আমার ঘুম আসছিলো না৷ পরে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম জানি না। আবার মাঝ রাতে মার আর্তনাদে আমার ঘুম ভেংগে গেলো। মা চিৎকার করে কাঁদছে।

টুনির মা- ঐডা নিয়েন না ঐডা টুনির লাইগা বানাইছি। আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে ঐডা নিয়েন না।

টুনি- তখনো বুঝিনি বাবা কি নিয়ে যাচ্ছে আর মা কেন বাঁধা দিচ্ছে। মা সারারাত কান্না করল। পরেরদিন দুপুরের দিকে বাবা বাড়ি ফিরল। মা চুপ করে বসে ছিলো।

মফিজ- ঐ ভাত দে। খিদা লাগছে।

টুনি- মা বাবার কথার কোন জবাব দিলো না।

মফিজ- কিরে কথা কানে যায় না ভাত দিতে কইলাম না।

টুনি- ও মা বাজান ভাত চায় বাজানরে ভাত দাও।

টুনির মা- ভাত নাই।

মফিজ- ভাত নাই কেন। আমি কি খামু।

টুনি- মা রাগ চোখে বাবার দিকে তাকায়৷

টুনির মা- আমার জিনিস ফিরায় দেন নাইলে আপনের লেইগা কোন ভাত নাই।

টুনি- মার কথা শুনে বাবার রাগে যেনো রক্ত টগবগ করতে লাগলো।বাবা রাগে মার চুলের মুঠি ধরে।

মফিজ- কি কইলি তুই। তোর এতো বড় সাহস। আমারে ভাত দিবি না তোরে বান্দি রাখছি কেন। এতো বড় সাহস তোর। তোরে আজকে মাইরাই ফালামু।

টুনি- বলেই বাবা মাকে মারতে লাগে। মা চিৎকার করতে থাকে।

দাদি- এই মফিজ কি করোছ কি মাইয়া ডা মইরা যাইবো তো ছাড় কইলাম ছাড়।

টুনি- বাবা মাকে ছুড়ে ফেলে চলে গেলো। তারপর দুদিন বাবা বাড়ি ফিরে নি৷ দুদিন পর বাবা বাড়ি ফিরলো। কিন্তু বাড়িতে আর শান্তি ফিরলো না। অশান্তি যেনো প্রতি বেলায় লেগেই আছে। মার প্রতি বাবার অত্যাচার গুলো বাড়তেই থাকলো। প্রায় প্রতিদিনই বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলতো। মাকে মারতো। এর মাঝেই আমার দাদিটা মরে যায়। মা সারাদিন কান্না করত। আমাকে দেখার মতো কেউ থাকল না৷ আমার মা টা দুঃখের অতল সাগরে ভাসতে থাকল। আমি জানি না কেন এমন হচ্ছে। কেন আমার বাবাটা এমন বদলে গেলো। মার কোলে শুয়ে ছিলাম জিজ্ঞেস করলাম।

টুনি- মা ও মা

টুনির মা- কি মা

টুনি- বাজানের কি হইছে মা??? বাজান কেন আমগো আগের মতো ভালোবাসে না। কও না মা কেন ভালোবাসে না বাজান??? কি হইছে বাজানের??

মার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছু বললেন না।

প্রতিনিয়তই বাবা টাকার জন্য মার গায়ে হাত তুলে। পরের দিন বাবা সাথে একজনকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সে কে জানি না৷ আমি আড়ালেই ছিলাম৷ বাবাকে দেখলে দৌড়ে যাই না। বাবা আগের মতো আদর করে কোলে নেয় না। বাবাকে দেখলে ভয় লাগে। সেদিন কি হতে চলেছে তা আমার জানার বাহিরে ছিলো। ঐ দিনই যে আমাদের জীবনটা এভাবে পাল্টে যাবে ভাবতেই পারি নি। আমি বাইরে থেকে মার চিৎকার আর আর্তনাদ শুনতে পেলাম।

টুনির মা- কি কন আপনে??? আপনের মাথা ঠিক আছে নি????

মফিজ- চুপ একদম চুপ। যা কই তা হুন। নাইলে মাইরা ফালামু তোরে।

টুনির মা- আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে এই কথা কইয়েন না। আল্লাহর গজব পরবো।

মফিজ- বেশি কথা কইলে তোর টুনিরেও বেইচা ফালামু।

টুনি- পরে বুঝতে পারলাম। বাবা জুয়ার নেশায় সব টাকা পয়সা শেষ করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত আমার মা টাকে ঐ লোকটার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। মা চিৎকার করে বলতে লাগলো।

টুনির মা- যা টুনি পালায় যা মা। ঐ অমানুষটা তোরেই বেইচা ফালাইবো যা মা ভাইগ্গা যাআআ। ওরা তোরে বাঁচে দিবো না মা পালায় যায়। আপনের দোহাই লাগে আমার টুনিরে ছাইড়া দেন। ওরে ছাইরা দেন।

টুনি- বাবা আমার দিকেই আসছিলো। আমি মার কথা শুনে দৌড়াতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। অনেক দূরে চলে এসেছি সামনে বিশাল নদী আর পথ নেই। একবার পিছনে তাকিয়ে বললাম “মা মা গো…”

মা গো বলতেই টুনির চোখ মুখ বেয়ে পরা পানি গুলোর স্রোতটা যেনো আরো বেড়ে গেলো। আমি স্পষ্ট দেখছি আমার অনু কাঁদছে। টুনি আবার বলতে শুরু করল।

টুনি- মা গো বলেই আমি সামনের বিশাল লঞ্চটায় উঠে পরলাম। কোথা যাচ্ছি কিছুই জানি না। শুধু জানি মা বলেছে পালায় যা টুনি তাই আমি পালাচ্ছি৷ মা আমাকে বাঁচার জন্য পালাইতে বলেছিলো তাই আমি পালাচ্ছি। ধূ ধূ পানি চারিদিকে হুইছেল দিয়ে লঞ্চ চলছে আপন গতিতে৷ একটা সময় এসে থামলো। একে একে সবাই নামছে কিন্তু আমি কোথায় যাবো??? কার কাছে যাবো??? আমি এতো মানুষের ভিড়ে আমার মাকে খুজতে লাগলাম। ” মা মাগো তুমি কই মা?? ও মা তুমি কই?? মাগো” হাজার মানুষে ভিড়ের ঠেলায় আমি আগাতে লাগলাম সামনে। সেই সকাল থেকে হেটেই যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু হাটছি। দিন শেষ হয়ে রাত হলো। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে গেলো চারিদিক। আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। এক অন্ধকার গলি ধরে হাটছি৷ তখনি পিছন থেকে কেউ বলল।

– কিরে যাবি নাকি???? দাম কত তোর??? এক রাতের কত নিবি???

টুনি- আমি একবার পিছনে ঘুরে দেখে সামনে দৌড়াতে লাগলাম ঐ লোকটাও আমার পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলো।

– কিরে দৌড়াচ্ছিস কেনো??? কত নিবি বল না।

অন্ধের মতো দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। তখনি একটা গাড়ির সামনে গিয়ে পরলাম। আল্লাহ হয়ত আমার ভাগ্যে মৃত্যুর চাইতেও ভালো কিছু লিখে রেখেছিলো। গাড়ি থেকে একজন ফেরেশতা নেমে এলেন।

হ্যাঁ, সে আমার জন্য ফেরেশতা। আমি তার পিছনে গিয়ে বললাম। আমারে বাঁচান। সে বলল-

-পিছনে দাড়া আমি দেখছি।

সেদিনের সেই ফেরেশতাটা আর কেউ নয় আমার স্যার আমার আরেকটা বাবা। যে সেই রাতে শুধু আমার সম্মানই বাঁচান নি আমাকে দিয়েছেন নতুন একটা জীবন।

.

.

#চলবে…….

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads