পতিতা পর্ব-২৩ | Potita -23 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

তুবা- তুই কি রে??? দু দিনের কথা বলে কোন খবরই নেই। আর কতো দেরি করবি??? আমার কথা শুন কালই এবোর্শনটা করিয়ে ফেল।

এবোর্শন কথাটা আবার শুনে আমার বুকের ভিতর ধুক করে উঠল। আমি মা হয়ে নিজের সন্তানকে কিভাবে মেরে ফেলি। কিন্তু আবার বাবা?? সন্তান হয়ে বাবাকে কিভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেই৷ অয়নকে আমি আমার অন্ধকার জীবনের সাথে জড়াতে চাই না। সে আমার জন্য যা করেছে তা যথেষ্ট বললেও কম হবে। তাই তাকে আর বিরক্ত করতে চাই না। আমার পরিবারের জন্য হলেও আমাকে সব মায়া ত্যাগ করতে হবে৷ পরিবারের জন্য নিজেকে শেষ করার পথে নামতে পেরেছি আর সামান্য এই ইচ্ছাটুকু, শখটুকুকে বাদ দিতে পারবো না তা কি হয়। আর এতো ভাবতে পারছি না প্রতি মূহুর্তে বাচ্চাটার জন্য মায়া বাড়ছে। বেশি দেরি করলে ওকে মারতে পারবো না৷ ওর মায়ায় পরে যাবো। যেমন ওর বাবার ভালোবাসার মায়ায় পরে গেছি। জানি ওর বাবা আমাকে ভালোবাসে না। আমি শুধুই তার একটা সময়ের প্রয়োজন ব্যতিত আর কিছু না। তবে আমি তো তাকে ভালোবাসি আর শুধু ভালোবাসি না অনেক বেশি ভালোবাসি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তাকে ভালোবাসার মতো কোন যোগ্যতা আমার নেই। নষ্ট মেয়েদের ভালোবাসতে নেই। সমাজের নষ্ট মেয়েগুলো কারো জীবনের রজনী হয় না। তারা হয় ঐসব পুরুষের একরাতের রজনী। রাত পাল্টায় মানুষটাও পাল্টায়। এতোদিন শুধু পাপি ছিলাম। যে অনেক বড় একটা পাপ করেছিলাম কিন্তু এর পর থেকে খুনীও হয়ে যাবো। পৃথিবীর সব চাইতে জঘন্যতম পাপটা করতে যাচ্ছি। তুবা আপু আমার জন্য ক্লিনিকে অপেক্ষা করছে। আপুই সব ব্যবস্থা করেছে। বলল এখানের ডাক্তারগুলো নাকি ভালো। আমার কষ্ট কম হবে। কথাটা শুনে আমি হেসে দিয়েছিলাম। আমার কষ্টতে কারই বা কি সে যায়। নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে যাচ্ছি এর চাইতে কষ্টের আর কি হতে পারে। শরীরের কষ্ট তো ২/৪ দিন পর এমনি সেরে যাবে। কিন্তু আমার ভিতরের রক্তক্ষরণ টা তো কেউ দেখবে না। কেউ বুঝবে না৷ আল্লাহ হয়ত আমার ভাগ্যে আর কোন সুখ অবশিষ্ট রাখেন নি।


ক্লিনিকে পৌঁছাতেই আপু আমাকে দেখে উঠে আসে।

তুবা- এতো সময় লাগলো যে???

আমি কোন জবাব না দিয়ে ফেলফেলিয়ে আপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

রেনু- সব ব্যবস্থা করেছো??

তুবা- সব রেডি আছে শুধু তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম। তুই এখানে বস আমি ভেতরে কথা বলে আসি সব রেডি কি না। দেড়ি করব না একদম।

রেনু- হুম।

আমাকে বসিয়ে রেখে আপু ভিতরে গেলো। মিনিট পাঁচের মাঝেই আবার ফিরে এলো।

তুবা- চল। এখনি শুরু করবে।

আমি ভেতরের দিকে পা দিতে নিয়ে আমার পিছনে ঘুড়ে দাড়ালাম।

তুবা- কি হলো??? কিছু বলবি???

রেনু- না কিছু না।

তুবা- ভিতরে যা।

আমার পা গুলো একদম সামনে যেতে চাইছে না। আমার মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই থেমে যাক৷ আমি কোন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি৷ যেনো এই সব কিছু স্বপ্ন হয়। আমি পারছি না এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে। কেনো মানুষ এতো করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। কেনো মানুষ এতো অসহায় হয়। সমাজের লাঞ্চনার ভয়ে আমি মা হয়েও নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারছি না কেমন মা আমি৷ আসলেই আমি মা হওয়ার যোগ্য না। আমিই বা কি করব ওর মা হওয়ার আগে যে আমি কারো সন্তান।

প্রতিটা পদক্ষেপ আমার কাছে অনেক কঠিন মনে হচ্ছে। মাত্র ৪ কদম গেলেই ওটি৷ তাও আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি বহুমাইল পেরোচ্ছি। পথ যেনো ফুরোচ্ছেই না।

ওটিতে ডুকতেই একজন আমাকে ওটির কাপড় দিলো পরে নেয়ার জন্য। একপাশে ছোট্ট ড্রেসিং রুমের মতো আমি সেখানে গিয়ে কাপড় পাল্টে ওটির কাপড় পরে নিলাম। ওখান থেকে বের হতে নিলেই দেখলাম একজন নার্স একটা ট্রেতে করে কি যেনো নিয়ে যাচ্ছে দেখতে মাংস পিন্ডের মতো। নার্সটা আমার পাশ দিয়েই গেলো আমি স্পষ্ট দেখলাম মানুষ আকৃতির একটা রক্তাক্ত মাংস পিন্ড। দেখেই আমার মাথা চক্কোর দিয়ে উঠল। আরেক জন নার্স আমাকে ধরে ফেললেন। একটু আগে যার এবোর্শন হয়েছে সম্ভবত বাচ্চাটা তার। নার্স নিয়ে যাচ্ছে ফেলে দেয়ার জন্য। একটু পর হয়ত এমনি একটা ট্রেতে করে আমার বাচ্চাটাকেও নিয়ে কোথাও ফেলে দিবে। যদি রাস্তায় বা ডাস্টবিনে ফেলে তাহলে তো রাস্তার কুকুরগুলো ছিড়ে ছিড়ে খাবে আমার বাচ্চাটাকে। কথা গুলো ভাবতেই আমার ভিতরের কেঁপে উঠে। মনে হচ্ছে কেই আমার কলিজাটাকে বার বার খামচে দিচ্ছে।

নার্স আমাকে শুইয়ে দিলেন। দুজন নার্স আমার দুপায়ের পাশে দাড়ালেন। তারা আমাকে পজিশন মতো ঠিক করলেন। আমি চোখ বন্ধ করতেই আমার চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠল এক দলা রক্তাক্ত মাংসপিন্ড আমাকে বলছে মা আমাকে মেরো না মা। মা আমি বাঁচতে চাই। মা আমাকে বাঁচতে দাও মা৷ মা মা গো…..

আমি কেঁপে উঠলাম।

তুবা আপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।

রেনু- আমি পারবো না আপু। আমি পারবো না ওকে মারতে। আমি পারবো না। আমি ওকে বাঁচাতে চাই।

আপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। কিছুই বললেন না। আপু আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে। তাই আমাকে আর কিছু না বলে আমাকে সেখান থেকে নিয়ে নিজের বাসা চলে আসে।

আপু মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারছি আপু প্রচন্ড রেগে আছে আমার উপর। তাই আমি আপুর হাত ধরে আপুকে সামনে বসালাম।

রেনু- সরি

আপু আমাকে কোন জবাব দিচ্ছে না।

রেনু- কথা বলবা না???

তুবা- কি বলবো??? আর বললেই কি শুনবি???

আমি মাথা নিচু করে রাখলাম।

তুবা- তুই আবেগ দিয়ে ভাবছিস রেনু। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। কি ভাবে জন্ম দিবি তুই এই বাচ্চাটাকে??? কার পরিচয়ে বড় করবি?? একটা সন্তান জন্ম দিতে হলে আগে বাবার পরিচয় প্রয়োজন হয়। কোথা থেকে দিবি তুই বাচ্চাটাকে বাবার পরিচয়??

আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলে শুধু অ বলতেই আপু গর্জে উঠল।

তুবা- এটা তার অবৈধ সন্তান।

অবৈধ শব্দটা শুনে আমার মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ বের হলো না। আপুর সাথে আমি আর কোন কথাই বললাম না। তুবা আপু আমাকে অনেক বুঝাবেন। আবেগের বসবর্তি হয়ে আমি যেনো নিজের জীবনটা আর না নষ্ট করি। এমনি নিজের অনেক ক্ষতি করেছি আর যেনো না করি। অনেক কথাই বললেন আপু আর আমি শুনলাম।

বাসায় যেতে একদম ইচ্ছে করছে না তাই তুবা আপুর বাসা থেকে অয়নের বাসায় চলে এলাম। জানি না কেনো মনে হয় এটা যেনো আমার আরেকটা ঠিকানা। যদি ঠিকানা টা স্থায়ী হতো৷ মানুষটা আমার জীবনে স্থায়ী হতো। কিন্তু তা হবে না জানি।

আসার পর থেকে টুনির সাথেও কোন কথা বলি নি৷ শুধু উপরে উঠার সময় টুনিকে বলেছি তেমার স্যার জানেনা আমি এসেছি আর এখন জানানোর দরকার নেই। সে অফিসে তাকে বিরক্ত করার দরকার নেই। আমার চোখ মুখ শক্ত দেখে টুনি শুধু মাথা ঝাকিয়ে সায় দিলো মুখে কিছু বলল না।

আমি বারান্দায় চুল ছেড়ে দাড়িয়ে রইলাম। টুনি আমার জন্য চা নিয়ে এলো।

টুনি- চা এনেছি আপনার জন্য।

আমি পিছনে না ঘুড়েই বললাম।

রেনু- টেবিলের উপর রেখে দাও।

টুনি বুঝে পারে আমি কোন কারণে ডিস্টার্ব। কিছু একটা আমাকে অনেক ভাবাচ্ছে। টুনি চলে যেতে নিলেই আমি ডাক দিলাম।

রেনু- টুনি শুনো

টুনি- জ্বি বলেন।

রেনু- আমি একটু একা থাকতে চাই। একান্তই একা।

টুনি আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলো। আমি সেখানেই দাড়িেয় রইলাম। তুবা আপুর বলা অবৈধ শব্দটা বার বার আমার কানে বাজতে লাগল। মনে হয় কেউ যেনো ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করে দিয়েছে আমার কানে। আমি কান চেপে চিৎকার করে উঠলাম না না ও অবৈধ না ও অবৈধ না।

টুনি সেই থেকে নিচে পায়চারি করছে। অয়নের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি টুনিকে একা থাকার কথা বলতেই টুনি রুম থেকে বেরিয়ে যায় ঠিকি কিন্তু টুনির মনের ভিতর আমার জন্য একটা চিন্তা ভর করে। কারণ এতো দিন হয়ে গেছে আমি কখনো এমন কথা বলি নি বা এমন আচরণ করি নি টুনির সাথে। তাই মেয়েটার চিন্তা হচ্ছিলো আমার জন্য। চিন্তা ধরে রাখতে না পেরেই টুনি অয়নকে ফোন করে জানায় আজ অনেক আগেই আমি চলে এসেছি আর একা থাকতে চাইছি। আমার কথা শুনার পর অয়ন এক মূহুর্তের জন্যও অফিসে থাকতে পারে নি। এমনিতেই কোন অজানা ভয়ে সকাল থেকে অয়নের ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। ঠিক মতো সারাদিন কাজে মনও দিতে পারে নি। বার বার মনে হয়েছে কি হচ্ছে বা হবে যার জন্য অয়ন এতো অস্থির হয়ে আছে। না জানি কোন বিপদ আসছে।

টুনির কাছে আমার কথা শুনার পর থেকে অয়ন পারছে না তো উড়ে চলে আসে আমার কাছে। অয়ন বাড়িতে ডুকতে ডুকতেই অয়ন মাথা ঝাকিয়ে ইশারায় টুনিকে জিজ্ঞেস করল কোথায়?? টুনি দরজায়ই দাড়িয়ে ছিলো হাত দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলো উপরে। অয়ন আর দাড়ালো না সোজা উপরে উঠে গেলো। রুমে ডুকতেই দেখে টি টেবিলে চায়ের কাপ রাখা। চা টা অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। এতো গুলো দিন গেলো অয়ন কখনো দেখে নি আমি হাতের কাছে চা পেলে তা পান করিনি। এমন কি আমি মাঝ রাতেও চা বানিয়েছি আমাদের জন্য। আমি রুমে নেই অয়ন জানে আমি কোথায় থাকতে পারি তাই বারান্দায় গিয়ে দেখে বাতাসে আমার খোলা চুলগুলো উড়ছে।

অয়ন পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

এতো দিনে অয়নের স্পর্শ, অয়নের গন্ধ, অয়নের অনুভূতি সব কিছুই বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছি। তাই আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা অয়ন।
.
চলবে…..
Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads