পতিতা পর্ব-১ | Potita – লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি লোকটার। জানি না সে কে??? শুধু জানি আজ সারারাত আমি তার চাহিদা মেটাবো বিনিময়ে সে আমার প্রয়োজন মেটাবে। জ্বি যা ভাবছেন তাই। আমি খারাপ মেয়ে। সমাজ আমার মতো মেেয়দের একটা অন্য নামে ডাকে। ব্যাইশা অথবা পতিতা। নিজেকে নিয়ে ব্যবসা করা মেয়েদের এই নামেই ডাকে সবাই৷ এতো দিন আমিও ভাবতাম এই মেয়ে গুলো হয়ত এতোটাই খারাপ বা জঘন্য তাই নিজেকে অন্য বেগাণা পুরুষের সামনে খুলে ধরতেও এদের লজ্জা করে না।

তবে আমিও ভুল ছিলাম বাকি সবার মতোই। একটা মেয়ে কতটা অসহায় হলে এই পথ বেঁছে নেয় আজ তা উপলব্ধি করতে পারছি হারে হারে। নিজেকে নর্দমার কিট মনে হচ্ছে তবু আমার কিছু করার নেই। আমাকে এটা করতেই হবে না হলে যে সব শেষ হয়ে যাবে।

ঘৃণায় আমার পা গুলো ঠান্ডা হয়ে আসছে। সেই কখন থেকে এই এক জায়গায় দাড়িয়ে আছি। জায়গাটাও কিছুটা অন্ধকার। গাঁ ঝমঝম করছে আমার। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে সময় ঘনাচ্ছে আমার কেমন যেনো লাগছে চারিদিক যেনো ঝাপসা হয়ে আসছে আমার ।হুট করে একটা গাড়ি এসে আমার কিছুটা সামনে থামলো একটা কালো গাড়ি ভেতরে কে আছে বুঝতে পারছি না তবে এই গাড়িটা যে আমার জন্য এসেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি এমনটাই নির্দেশনা পেয়েছিলাম ফোনে।
 
গাড়িটা দুমিনিট আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আমিও সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার পাগুলো আগাচ্ছে না। তাই নরতে পারছিনা। ঝিম ধরে রয়েছি।
 
গাড়ির সামনের গ্লাস টা একটু খোলা হল ভেতর থেকে কেউ জোরে জোরে ২/৩ বার হর্ন দিলো। আমার পাগুলো তো আগেই ঠান্ডায় বরফ হয়ে গেছে তারপরেও মনকে বুঝ দিয়ে সামনে পা বাড়ালাম। কিছুটা কাছে যেতেই ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল গাড়িতে উঠে বসো। আমি আর অপেক্ষা না করে পেছনের দরজায় হাত দিতেই আবার বলে উঠলো সামনে এসে বসো। তাই অপর পাশে ঘুরে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে কেউ দরজাটা খুলে দিলো। আমি কাউকে দেখলাম। না কিছুই দেখলাম না। চুপচাপ বসে রইলাম। আমার পাশে কেউ একজন গাড়ি চালাচ্ছে সে কি বা কেমন দেখতে আমার তা দেখতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঠায় ঝিম ধরে বসে রইলাম। গাড়ি চলছে গাড়ির মতো। পাশের মানুষটাও আমার সাথে কোন কথা বলল না। না জিজ্ঞেস করল আমার নাম। তার কাছে হয়তো আমার নামটা মুখ্য নয় সে যে কাজে এসেছে হয়তো সেটাই মুখ্য। তাই নাম দিয়ে তার কি আসে যায়। বেশকিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো। হর্ন দিতেই ভিতর থেকে কেউ মস্ত বড় দরজা খুলে দিলো। গাড়িটা হন হন করে ভিতরে ঢুকে গেলো। পাশের মানুষটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি সামনে দেখছি লোকটা আমাকে এভাবেই গাড়ীতে রেখে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। অথচ আমি বসে আছি আমি কি করব কিছুই বলল না। নামবো না বসে থাকব। তার পেছনে যাবো না তার সাথে যাবো। হয়তো বলাটা প্রয়োজন মনে করল না। আমি তো আর তার কাছে আর দশটা মানুষের মতো নই। একটা বাজে মেয়ে। লোকটা ভিতরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কেউ একজন এসে গাড়ির দরজাটা খুলে আমাকে বলল আপনি ভিতরে যান। আমিও তার পথ অনুসরণ করে ভেতরে চলে গেলাম।

মস্ত বড় একটা বাড়ি। খুব সুন্দর করে সাজানো। এমন জায়গায় থাকলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। তাহলে এই মানুষটা এমন কেনো?? সে কেনো আমাকে আনতে গেলো?? সে কেনো আমার মত একটা মানুষের কাছে গেলো?? হুট করেই প্রশ্নগুলো মনে আসলো। কিন্তু এসব প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই। আমার প্রয়োজন টা অন্য জায়গায়। আর প্রয়োজন কারো মায়া বোঝেনা। আমি চারিদিকে দেখতে লাগলাম। কি সুন্দর করে সাজানো। কি সুন্দর করে গোছানো দেখতে দেখতেই কারো একজনের সাথে ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেয়ে তার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে আমার হাত ধরে হনহন করে আমাকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গেলো। তার বেডরুমে নিয়ে গেলো। দেখাই বোঝা যাচ্ছে এটা কারো বেডরুম সে থেকেই বুঝলাম এটা তার বেডরুম। আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম সে বলল-

-তুমি ফ্রেশ হয়ে নিতে পারো। আমার কিছু কাজ আছে আমি কাজ শেষ করে আসছি।

কথাটা বলে সে আমার জবাবের অপেক্ষা না করে চলে গেলো। আমি তাকে দেখতেও পারলাম না৷ কেনো যেনো খুব ঘৃণা লাগছে চোখ তুলে ঐ মানুষটার দিকে তাকাতে। না তাকে নয় ঘৃণা লাগছে নিজেকে। তাই চোখ তুলে তাকাতে পারি নি। দেখতে পারি নি কোন মানুষটার হাতে নিজের সর্বনাশ করতে আসলাম।

আমি সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম কি করছি আমি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি। একজনের ডাকে আমার হুসফিরল।

-ম্যাম শুনছেন??

-জি বলেন।

-স্যার এটা আপনার জন্য পাঠিয়েছে। আপনি ফ্রেস হয়ে পরে নিন। আর ডিনারে কি খাবেন??

-পানি।

-মানে???

-গলাটা শুকিয়ে গেছে একটু পানি হবে প্লিজ।

-সিওর ম্যাম।

মেয়েটা আমাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে আবার বলল।

-ম্যাম বললেন না ডিনারে কি খাবেন???

আমি আবার ভাবনায় পরে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম আমি আর কি খাবো। খাবে তো আজ রাতে ঐ লোকটা আমায়। মেয়েটার ডাকে আবার ফিরে এলাম।

-ম্যাম আবার কি ভাবছেন??

-না কিছু না।

-কি বানাবো আপনার জন্য।

-আমি কিছুই খাবো না।

-সে কি কথা।

-সত্যি খিদে নেই আমার।

-বুঝতে পেরেছি লজ্জা পাচ্ছেন সমস্যা নেই আমি নিজেই আপনার জন্য স্পেশিয়াল কিছু তৈরি করছি। আপনি ফ্রেস হয়ে নিন।

বলেই মেয়েটা চলে গেলো। মেয়েটা দেখতে অনেক মায়াবি৷ খুব লক্ষি বুঝা যাচ্ছে।

মেয়েটা চলে যেতেই আমি শাওয়ার নিয়ে নিলাম। মেয়েটা আমাকে একটা কালো সিল্কের শাড়ি দিয়ে গেছে। মেয়েটা নয় ঐ লোকটা পাঠিয়েছে। শাওয়ার নিয়ে শাড়িটা পরে নিলাম। আমার মুখে কোন সাজ নেই। ভেজা চুল গুলো ছেড়ে দিলাম। ছোট বেলা থেকেই আমার চুলের অনেক শখ৷ তাই খুব যত্ন করতাম নিজের চুলের। ভেজা চুল গুলো ছাড়তেই কোমড়ের নিচে গিয়ে পরল। আমার সব চাইতে পছন্দের জিনিস আমার চুল। সবাই বলে আমার বর নাকি আমার চুলের পাগল হবে। সে নাকি সর্বক্ষণ আমার চুল হাতড়াবে। আমার পোড়া কপালে আর তা ঝুটল না।

-বাহ বেশ লাগছে তো দেখতে।

পিছনে ঘুড়েই দেখলাম ঐ মেয়েটা। আমি বললাম।

-না দেখে কিভাবে বুঝলেন??

-যার চুল এতো সন্দুর সে যে কতটা সুন্দর হতে পারে তা বোঝাই যায়।

-আমি সুন্দর???

-এক মিনিট প্লিজ।

মেয়েটা আমাকে এক মিনিট বলে খাবারের ট্রলিটা রেখে কোথায় যেনে চলে গেলো। এক মিনিট পরেই আবার ফিরে এলো। মনে হয় দৌড়ে এসেছে।

-দেখি তো।

আমি মেয়েটার দিকে তাকাতেই ও আমার কপালে কিছু একটা দিয়ে আমাকে পিছনে ঘুড়িয়ে দাড় করলো। আয়নদয় তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা আমাকে ছোট্র একটা টিপ পরিয়ে দিয়েছে। একটা ছোট্ট কালো টিপ। আমি মেয়েটার কান্ডে অবাক হয়ে গেলাম। কালো টিপ আমার খুব পছন্দ।

-এখন আপনাকে পূর্ণাঙ্গ লাগছে। যেনো সৌন্দর্য্যের প্রতিমা।

-নাম কি তোমার???

-টুনি..

– বাহ খুব সন্দর নাম।

মেয়েটা ওর নামের মতোই মিষ্টি। একদম টুনটুনি পাখির মতো। মেয়েটা আমার কাছে কিছুই জানতে চাইল না। আমি কেনো এসেছি বা আমার নাম কি কিছুই জানতে চাইলো না। টুনি আমার হাত ধরে আমাকে বসালো। আমাকে খাবার দিয়ে বলল।

টুনি- খান।

-তোমার স্যার খাবেন না???

প্রশ্নটা করে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কেনো করলাম আমি এই প্রশ্নটা?? হয়ত বেশকিছুক্ষণ ধরে ঐ লোকটার কথা ভাবছি তাই নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা করে ফেলেছি।

টুনি- স্যারকে খাবার দিয়েই এসেছি। স্যারই বললেন আপনাকে যেনো খুব যত্ন করে খাওয়াই।

কথাটা শুনে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম৷ ভাবলাম পশু হালাল করার আগে যেমন তাকে খাওয়ানো হয়। সেভাবে আমাকে হালাল করার আগে যত্ন করছেন লোকটা৷ মুখে আর কিছুই বললাম না৷

টুনি- খান না। মাটন কারি স্যারের খুব পছন্দ। ভাবলাম আপনার ও হয়ত ভালো লাগবে।

টুনি আমাকে খুব যন্ত করে খাওয়ালো। অনেক কথা বললো। আমি কত সুন্দর সেটা বলল। নিজের কথা এসবই বলল। আমার কাছে তেমন কিছুই জানতে চায় নি। খাওয়া শেষ হতেই টুনি বলল।

টুনি- চা খাবেন??

আমি টুনির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

টুনি- বুঝতে পেরেছি। স্যারেরও রাতে ডিনারের পর চা ছাড়া চলে না। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি রেস্ট করেন। স্যার অল্প সময়ের মাঝেই চলে আসবেন।

ঐ লোকটার আসার কথা শুনেই বুকের ভিতর যেনো কেউ চেপে ধরল। টুনি চলে যাচ্ছে। আমি পিছন থেকে ডাকলাম।

-টুনি

টুনি- জ্বি বলেন।

-তোমার মনে হয় না আমি বাজে মেেয়।

টুনি- না আমার তা মনে হয় না।

কথাটা বলেই টুনি আর কোন প্রশ্ন বা কথার অপেক্ষা বা সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। একজন এসে চা দিয়ে গেলো। টুনি এলো না। আমি চা হাতে ভাবতে লাগলাম। টুনি কেনো এলো না। তাহলে কি ঐ প্রশ্নটা করায় টুনি কিছু মনে করেছে। টুনি কি জানে আমি কে বা কেনো এসেছি?? টুনি কি জানে ঐ লোকটা আমায় কেনো এনেছে?? বার বার প্রশ্নগুলো আমায় তাড়া করছে। জানি আজকের রাতটা চলে গেলে কাল চলে যাওয়ার পর আর কখনো টুনি নামের এই মেয়েটার সাথে আমার দেখা হবে না। কখনো না। তাও মেয়েটার কথা আমাকে তাড়া করছে। আমাকে ভাবাচ্ছে। ভাববেই তো আমিও তো মানুষ। আমারও তো মনুষ্যত্ব আছে। আমি তো আর কোন বিবেকহীন পশু নই। শুধু আমার বাস্তবতাটা কেবল আমি জানি অন্য কেউ নয়।

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই দক্ষিণা বাতাস এসে লাগলো। আমি চা হাতে বারান্দায় চলে এলাম।

আমি মনে মনে গুণ গুণ করে গাইতে লাগলাম-

তোমার খোলা হাওয়া…..

কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরেই আমি থেমে গেলাম। পিছনে ঘুড়তেই দেখি সেই লোকটা।

আমি কখনো প্রেম করিনি। ভালোবাসা নামের অনুভূতিটার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। নেই কোন পরিচিতি। তবে আজ আমার খুব প্রেমে পরতে মন চাইছে। আমি কখনো ছেলেদের সাথে তেমন একটা মিশি নি। শুনতাম ছেলেদের নাকি পাঞ্জাবিতে খুব সুন্দর লাগে দেখতে। আর এমন সুদর্শন একজন পুরুষ যখন ধবধবে সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে সামনে দাড়ায় কার না মন চাইবে প্রেমে পরতে। আমি আর ১০ টা সাধারণ মেয়ের মতো হলে হয়ত তাকে প্রেম নিবেদন করতাম। কিন্তু কি কপাল আমার এই লোকার সাথেই আমার অন্ধকার জীবনের পথ চলার শুরু হবে। এই লোকটাকে দিয়েই শুরু হবে জানি না কার সাথে বা কোথায় গিয়ে এই অন্ধকার জীবনের শেষ হবে। আমি জানি না।

লোকটা কিছুক্ষণ তব্দা খাওয়ার মতো দাড়িয়ে থেকে আমাকে দেখলো। তার এই দৃষ্টিতে কি যেনো আছে। কি না অনেক কিছু আছে। রাগ, জেদ, অভিমান,কষ্ট,দুঃখ,ভালোবাসা সব দেখতে পারছি আমি সব।

লোকটা আমার হাত ধরে আমাকে একটা হ্যচকা টান দিয়েই কোলে তুলে নিলেন। আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা পরে ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ঠিক যেভাবে এখন আমি টুকরো টুকরো হবো।

সে আমাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে পাগল হয়ে গেলেন। পাগলের মতো আমার শাড়ির আচলটা সরিয়ে দিয়ে যেনো এক নেশায় মেতে উঠলেন সে। এক পাগল করা নেশায় মেতেছে সে। আমি পারছি না তাকে বাধা দিতে। কারণ আমাকে যে পারতেই হবে তাহলেই না বিনিময়ে আমার প্রয়োজন টা মিটবে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার প্রচন্ড। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটা হাড় মট মট করে কেউ ভেংগে দিচ্ছে। আমি পারছি না সহ্য করতে। তর তর করে চোখ বেয়ে পানি পরে দু পাশে বালিশ ভিজছে। এই মানুষটার এটা দেখারও সময় নেই। দেখবেই বা কেনো। আমি তার প্রয়োজন মিটাচ্ছি বিনিময়ে সে আমার প্রয়োজন মেটাবে। এমনটাই তো কথা হয়েছে তার সাথে। তার প্রতিটা স্পর্শে আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি। কারো প্রতি তার খুব রাগ। খুব অভিমান। কোন অজানা কষ্টের আগুণে পুড়ছে সে। আর আজ সেই আগুণের জ্বালাই মেটাচ্ছেন আমাকে দিয়ে। আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। তবু হাত মুখ খামছে পরে রইলাম। প্রচন্ড ব্যথা, অসহ্য কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কখন যেনো জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম নিজেও জানি না।
.
.
.
#চলবে……….
Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads