পতিতা পর্ব-১২ | Potita -12 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

নিজের অজান্তেই তার জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি বেয়ে পরল আমার।

তার আমাকে দেয়া কষ্ট গুলোর কারণ বুঝতে পারছি। এতোদিন জানতাম পৃথিবীতে আমার দুঃখ সব চাইতে বেশি হয়ত৷ আজ দেখছি আমার মতো হতভাগার অভাব নেই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। শুধু কষ্টের কারণ গুলো ভিন্ন। সারারাত এ্যালবামে তার ছবিগুলো দেখেই কাটিয়ে দিলাম। এতোদিন তো তাকে দেখতাম আর ভাবতাম একজন পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে৷ আজ দেখলাম তার হাসিটা তার চাইতেও বেশি সুন্দর। আমার দেখতেই ইচ্ছে করছে। কতটা পাষোন্ড হলে কেউ এমন একটা মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারে। আমি তো এই হাসি দেখেই জীবন পার করে দিতে পারতাম তাহলে তার ভালোবাসার মানুষটা কেনো পারল না।

সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে গেলো প্রায়৷ হুট করেই চোখ লেগে যায় আমার আর তখনি টুনি এসে ডেকে দেয়। আজ বাসায় যাবো৷ সময় মতো না গেলে আবার কোনো সমস্যায় পরতে পারি। অফিস টাইম একটু এদিক সেদিক হতে পারে কিন্তু ট্রেন তো আর এদিক সেদিক হবে না। সময় মতোই আসবে। জীবনটা মিথ্যের উপর চলছে। কখনো কল্পনাও করিনি নি। এভাবে মিথ্যেই একদিন আমার নিত্যসঙ্গী হবে৷ ভালো লাগে না। একটা মিথ্যেকে ঢাকার জন্য আরো হাজারটা মিথ্যে বলতে হয়। কখনো কখনো মনে হয় বলে দেই সত্যিটা আবার পরক্ষণেই মনে হয়। নিজেকে তো শেষ করেই দিয়েছি। এখন সত্যিটা জানলে আমার জ্যান্ত বাবা মা টাও মরে যাবে৷ এর চাইতে আমি নিজেই জ্যান্তলাশ হয়ে বেঁচে থাকি। তাই আর না ঘুমিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম।

৪দিন পর বাসায় ফিরলাম। সারারাত ঘুমাই নি বলেই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই দিন পার করে দিলাম।

এখন প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেছে দিনে ঘুমানো আর রাত জেগে টুনির সাথে গল্প করা। সারাদিন বাসায় মার সাথে সময় দেই। বোনদের সাথে গল্প আড্ডায় দিন কাটে। আর রাত হলেই চলে যাই টুনির কাছে টুনির স্যারের গল্প শুনতে। টুনি এতো বেশি ওর স্যারের কথা বলে যে মনেই হয় না মানুষটা দূরে আছে বা সে আমার অপরিচিত কেউ। মনে হয় যেনো কত চেনা সে আমার, কত কাছের মানুষ, আমার আপন মানুষ। অনেক দিন পর স্বাভাবিক দিন কাটাচ্ছি।

১৯ দিন হয়ে গেলো মানুষটা গেছে। এখনো আসে নি। কবে আসবে তাও জানি৷ তবে ইদানিং তার শূন্যতা আমাকে অনেক ভাবায়। জানি না কেনো তার কথা ভাবতেও ভালো লাগে ইদানিং। মনে মনে তার কথা ভাবি আর মিট মিট করে হাসি৷

অনু ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো।

অনু- তুমি একা একা হাসছো কেন??

রেনু- কই একা একা হাসলাম।

অনু- হ্যাঁ হাসছো। আমি দেখেছি৷ বলো কি হয়েছে।

রেনু- আরে না ভুল দেখেছিস।

অনুর সাথে আর কথা বাড়ালাম না। শুয়ে পরলাম। গতরাতেও টুনির সাথে সারারাত গল্প করেছি ঘুমাই নি৷ তাই শুয়ে পরতেই ঘুমিয়ে পরলাম।

মা- রেনুউউউউউউউউউউউউউউ

হঠ্যাৎ মায়ের চিৎকারে ঘুম ভেংগে গেলো। চোখ খুলতেই মা আর তনুর চিৎকার শুনতে পেলাম। হুট করে এভাবে ঘুম থেকে উঠায় আমার যেনো আত্মা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। উঠে দাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে৷ মা আর তনু বাবার ঘর থেকেই চিৎকার করছে এটা বুঝতে পারছি৷ অনেক কষ্টে উঠে নিজেকে সামলে বাবার ঘরে গিয়েই যেনো আমার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেলো৷

মা- রেনু রে তোর বাবা

মা চিৎকার করছে আর কান্না করছে।

তনু- আপু দেখো না বাবা বাবা কথা বলে না। আপু

আমার যেনো পুরো দুনিয়াটাই অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি কথাও বলতে পারছি না৷ তনু আমাকে ধরে ঝাকি দিলো। ঝাকি দিতেই আমি যেনো হুস ফিরে পেলাম। বাবার পাশে গিয়ে বসলা।

রেনু- ও বাবা বাবা। বাবা কথা বলো বাবা। বাবা

মা- দেখ না রেনু তোর বাবা কথা বলে না।

রেনু- দাড়াও মা আমি দেখছি।

বলেই আমি বাবার পালস চেক করলাম। নাহ চলছে তার মানে বাবার কিছু হয়নি।

রেনু- তনু দৌড় দে আমার ফোনটা নিয়ে আয় যলদি। মা প্লিজ কেঁদো না।

তনু ফোন নিয়ে আসতেই আমি হসপিটালে কল দিলাম এম্বুলেন্সের জন্য। বেশি সময় লাগলো না এম্বুলেন্স চলে এলো। বাবাকে এম্বুলেন্সে উঠাতেই অনু দৌড়ে এলো। এসময় অনুর টিউশনি থাকে৷

অনু- বাবার কি হয়েছে আপু।

রেনু- তুই মা আর তনুকে নিয়ে একটা সিনজি করে চলে আয়। আসলে বলছি সব।

অনুকে বলেই আমি বাবার সাথে এম্বুলেন্সে উঠে গেলাম।

হাসপাতালে পৌছাতেই বাবাকে আই সি ইউ তে ডুকানো হলো। যে ডাক্তার বাবার চিকিৎসা করেন সে বাবার বন্ধু হোন। রহমান আঙ্কেল।

রেনু- আঙ্কেল বাবা

ডাঃ রহমান- চিন্তা করে না মা আমি দেখছি৷

বলেই আঙ্কেল ভিতরে চলে গেলেন। ততোক্ষণে মা আর অনু তনুও চলে এলো।

মা- তোর বাবা কোথায়???

রেনু- মা ধৈর্য্য ধরো। বাবাকে আই সি ইউ তে নিয়ে গেছে৷ আঙ্কেলও গেছেন।

কিছুক্ষণ পরেই আঙ্কেল বেরিয়ে এসে বললেন বাবাকে ভর্তি করে ফেলতে।

রেনু- ভর্তি করবো???

ডাঃ রহমান- হ্যা ভর্তি করা লাগবে।

রেনু- বাবার কি হয়েছে আঙ্কেল???

ডাঃ রহমান- আমার স্ট্রোক করেছে।

মা চিৎকার করে দিলেন আবার স্ট্রোক করেছে শুনে।

রেনু- আঙ্কেল বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো???

ডাঃ রহমান- আল্লাহকে ডাকো। আমরা যথা সাধ্য চেষ্টা করছি।

আমি অনুকে মাকে দেখতে বলে বাবাকে ভর্তি করতে চলে গেলাম। প্রাইভেট হাসপাতালে অনেক খরচ কিন্তু কিছু করার নেই আমার বাবাকে বাঁচাতে হলে এখানেই ট্রিটমেন্ট করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে তো সুস্থ মানুষগুলো গিয়েও লাশ হয়ে ফিরে আসে চিকিৎসার অভাবে। আমি আমার বাবাকে হারাতে চাই না। আর টাকা যা আছে মনে হয় হয়ে যাবে। তাই সাত পাঁচ না ভেবে বাবাকে ভর্তি করে ফেললাম। পরিবারের জন্যই তো নিজেকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছি। আমি বেঁচে থাকতে বাবাকে কষ্ট পেতপ দিবো না।

কিছুক্ষণ পরেই একজন নার্স এসে বড় একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলো। রহমান আঙ্কেল বাবার বন্ধু এই সুবাধে সে আমাদের থেকে কখনো ফিস নেয় না। কিন্তু হাসপাতালের বিলের ক্ষেত্রে তারও কিছু করার নেই। তবে উনি থাকায় ভালোই হয়েছে। একান্ত যেটা প্রয়োজন উনি সেটাই প্রেসক্রাইপ করেন। অন্যথায় অন্য সব ডাক্তাররা আর হাসপাতাল গুলোতে তো একটার জায়গায় সাতটা মেডিসিন কেনায়।

আমি গিয়ে মার পাশে বসলাম। মা আমার কাঁধে মাথা রাখলেন।

রেনু- চিন্তা করো না মা বাবার কিছু হবে না।

মা নিরবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। অনু তনুও কাঁদছে। শুধু আমিই কাঁদতে পারছি না। কিভাবে কাঁদবো আমি৷ আমি কাঁদলে এই মানুষগুলোর চোখের পানি মুছবে কে। তাই আমাকে শক্ত থাকতেই হবে। মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়। যেমনটা ঠিক এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে। আমার মতো সন্তান গুলো মনের ইচ্ছে মতো চোখের পানিও ফেলতে পারে না। এই সন্তান গুলো পৃথিবীর সব চাইতে হতভাগা। অনেকটা সময় পর ডাক্তার আঙ্কেল বেরিয়ে এলেন।

ডাঃ রহমান- বলেছিলাম অনেক সাবধানে রাখতে হবে। হুট করে আবার স্ট্রোক করলো কেনো???

রেনু- আমি তো কিছুই জানি না।

মা- অনেক বেশি চিন্তা করে মেয়েদের নিয়ে।

রেনু- মা তুমি আমাকে আগে বলো নি কেনো?? আঙ্কেল এখন কি অবস্থা??

ডাঃ রহমান- আপাততো আই সি ইউ তেই রাখবো। আশা করি এ যাত্রায়ও বেঁচে যাবে।

সারাদিন আমরা হাসপাতালের করিডরে বসে রইলাম। আমাদেরকে এখনো ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয় নি। বাবার এখনো জ্ঞান ফিরেনি৷

অয়ন- রেনুউউউউউউউউউউউ….

হুট করেই রেনু বলে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসলো অয়ন চৌধুরী। ঘেমে একাকার অবস্থা। প্রচন্ড ভয় লাগছে অয়নের রেনুর জন্য। এতো বাজে একটা স্বপ্ন কেনো দেখলো অয়ন রেনুকে নিয়ে। কেমন আছে রেনু??? অস্থির লাগছে অয়নের। ফোনটা কোথায় রেখেছে খুজেও পাচ্ছে না। অয়ন এমনিতেই অনেক রাগি। এখন যেনো রাগটা মাথায় চেপে বসছে। ফোনটা হাতে পেতেই ফোনের স্ক্রিন লকটা খুলতেই রেনুর চেহারাটা ভেসে উঠল।কল লগে গিয়ে রেনুর নাম্বারে কল দেয় অয়ন। কিন্তু না কল টা কানেক্ট হচ্ছে না। অপর পাশ থেকে ভেসে আসছে-

.

The Number you are calling is not available at the momemt please try again after some time thank you.

.

অয়ন কল টা কেটে আবার কল দিলো। কিন্তু না আবার একি কথা বলছে। অয়ন আবার কেটে দিয়ে আবার কল দেয় বার বার একি কথা বলছে। অয়নের অস্থিরতাটা যেনো বেড়েই চলেছে। যতক্ষণ না রেনুর সাথে কথা হবে অয়নের অস্থিরতা কিছুতেই কমবে না। আর এখনো দেশে রাত হয় নি তাই টুনিকে কল দিলেও কোন কিছু জানা যাবে না৷ রাত না হওয়া পর্যন্ত যে রেনু অয়নের বাসায় আসবে না। কিভাবে যে সময় টা কাটাবে অয়ন নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে এর আগে কখনো অয়নের এমন মনে হয় নি।

.

চলবে……

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads