মায়াকথন পর্ব-৮ | Mayakathon -8 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

নিজের ঘরের বিছানায় চিত হয়ে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে মায়া। সারারাত ঘুমায়নি সে। এতো এতো দিন পর নিজের জীবনের একমাত্র কামনাময় পুরুষটাকে চোখের সামনে দেখে নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করে রাখলেও এই মুহূর্তে মায়া আর নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। এই মানুষটাকে ঘিড়ে বেহিসাবি অনেক স্বপ্ন বুনেছে মায়া তার সঙ্গে, তার আড়ালে। অনেক দুষ্টু দুষ্টু কামনা-বাসনাও করেছে নীরব চিত্তে। যা সবই এখন কেবল অতীতের রঙিন পাতার স্মৃতি ব্যতীত কিছুই নয়। নওয়াজকে দেখার পর থেকে নিজেকে গুলিয়ে ফেলেছে মায়া। এতো বছর পাথরের মতো জীবন যাপন করে মানুষটা চোখের সামনে আসতে না আসতেই গলে পানি হয়ে গেছে তার মন। মানুষটাকে মুখের উপর না করে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে মায়াকে। তবু সে তাকে প্রত্যাখান করে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে। তাকে প্রত্যাখান করতে হয়েছে। আসল সত্যিটা মায়া পারেনি নওয়াজকে বলতে। তাই সত্যিটাকে নিজের মতো বানিয়ে বলে এসেছে সে। পুরোপুরি মিথ্যে বলেছে তাও নয়। নিজের সর্বনাশের কথা ঠিকি বলেছে সে তবে তা নিজের মতো সাজিয়ে। আসল সত্যটা মুখ ফুটে বলার সাহস তার হয়নি। অনবরত পরতে থাকা মায়ার চোখের পানি দু’গাল বেয়ে পরে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সেদিন যখন মুনমুনের বাসায় ঐ জানোয়ারটা হামলা করেছিল সেদিন জানোয়ারটা একটা নয় তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। একজন নয়, কয়েকজনের হাতে মুনমুন তার সব হারিয়েছে। হয়ত সেখানে থামলেই বিষয়টা অন্যরকম হতো কিন্তু যখন মুনমুনের নিজের দুলাভাই তার সর্বনাশে অংশ নিলো। তার আপন মায়ের পেটের বোনের স্বামী যখন নিজের মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে রাতভর না খেয়ে থাকা হিংস্র জানোয়ারের মতো তার ইজ্জত খুবলে খেয়েছে তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি মুনমুন। রাগে, দুঃখে, কষ্টে জানোয়ারটার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল সে। বাকিদের সে হাতের নাগালে পায়নি কিন্তু দুলাভাই নামক ঘরের বিভীষণটাকে সে জ্যান্ত রাখে না। ঐ মুহূর্তে মুনমুনের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। সে কি করে ফেলেছে তা সে নিজেও জানে না। তারপর যখন হুঁশ হলো নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। কি করবে কিছুই মাথায় আসেনি মুনমুনের। পুড়ে কুঁকড়ে যাওয়া লাশটার দিকে বেশ লম্বা সময় তাকিয়ে থেকে বমি পেয়ে গিয়েছিল মুনমুনের। তার দৃষ্টি কোণ থেকে সে কোনো অন্যায় করেনি। বরং নিজের সাথে হওয়ার অন্যায়ের বিচার করেছে। কিন্তু এই কথা পৃথিবী মানবে না, আইন মানবে না তা মুনমুন নিজেও জানে। তবে পালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা মুনমুনের ছিল না। বেশ লম্বা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুনমুন লাশটার দিকে। তারপর বাসার কলিংবেলটা বেজে উঠতেই চমকে ওঠে মুনমুন। এই সময় কে আসতে পারে ভেবেই শিউরে ওঠে। থমথমে পায়ে দরজার কাছাকাছি এসে পীপহোল দিয়ে দেখে ছায়া দাঁড়িয়ে। বোনকে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে মুনমুন। দরজা খুলে দাঁড়াতেই ছায়া জিজ্ঞেস করে, “এতক্ষণ লাগল কেন তোর দরজার খুলতে?”
কাছে এগিয়ে এসে আবার জিজ্ঞেস করল, “তুই ঠিক আছিস তো? এতবার কল দিলাম ধরিসনি কেন?”
ছায়াকে পেয়ে যেন মনের জোর ফিরে ফেল মুনমুন। বোনকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। আচমকা মুনমুনকে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে যায় ছায়া। আশেপাশের কেউ শুনে ফেলার আগেই ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিয়ে ছায়া জিজ্ঞেস করে, “কাঁদছিস কেন তুই! কী হয়েছে?”
মুখে কিছুই বলতে পারে না মুনমুন। হাত ধরে টেনে ছায়াকে নিয়ে ভেতরে চলে আসে। নিজের স্বামীর পুড়ে, কুঁকড়ে যাওয়া লাশ দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় ছায়া। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে মুনমুনকে ঝাঁকি দিয়ে বলে, “এখন কী হবে?”
“আমি পুলিশে খবর দিয়েছি আপু। তারা চলে আসবে।”
“পুলিশ! তোর মাথা ঠিক আছে কী বলছিস তুই?”
“ঠিকই বলছি আপু। এই জানোয়ারটাকে মারার দায়ে যদি আমার ফাঁশিও হয় তাতেও কোনো আপত্তি নেই। আমার যা খোয়া যাওয়ার যা তা খুইয়ে ফেলেছি আমি। এরপর ফাঁসি হলেও আমার আপত্তি নেই।”
“তোর মাথা ঠিক নেই। তুই জানিস না তুই কী বলছিস।”
কী করবে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পরে ছায়া। ঐদিকে সময়ও বেশি নেই যেকোনো সময় পুলিশ চলে আসবে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ছায়া বলল, “তুই চলে যা মুনমুন।”
অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে মুনমুন বলল, “কোথায় যাবো? আমি পালাতে চাই না আপু।”
“আমি এতো কিছু জানি না। পুলিশ আসলে আমি দেখে নিবো। তুই চলে যা।”
“না আপু।”
মুনমুনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তার একটা হাত নিজের মাথায় নিয়ে ছায়া বলল, “তোকে আমার আর আমার পেটের বাচ্চার দিব্যি মুনমুন তুই চলে যা। তোর জায়গায় পুলিশ আমাকে নিয়ে গেলে হয়ত বাচ্চাটার জন্য আমাকে ফাঁসি দিবে না। কিন্তু তোকে… না আমি থাকতে তোর সাথে এমনটা আমি হতে দিতে পারব না। তোকে বাবা-মার কসম তুই চলে যা।”
“আপু!”
“চলে যা বোন আমার।”
বাধ্য হয়ে মুনমুনকে সেদিন বোনের কসম মেনে পালাতে হয়েছিল। মুনমুন বেরিয়ে আসার আগে ছায়া তাকে আরও বলেছিল, “কথা দিয়ে যা যেখানেই থাকিস, যাই করিস না কেন তুই বেঁচে থাকবি। তোকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তুই করবি তবু বেঁচে থাকবি।”
সেদিন ছায়াকে দেয়ার মতো কোনো জবাব ছিল না মুনমুনের কাছে। বোনের দেয়া কসমের দায় নিয়ে তাকে বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে আসতে হয়েছিল মুনমুনকে। তখন মুনমুন ভেবেছিল কয়টা দিন আড়ালে থাকবে সে। তারপর সব স্বাভাবিক হলে বোনকে খুঁজে বের করে আবার তারা আগের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে। কিন্তু মুনমুন কোথাও পড়েছিল নিয়তির পরিকল্পনার কাছে ব্যক্তি পরিকল্পনা খুবই তুচ্ছ জিনিস। ব্যক্তি পরিকল্পনাকে হেরে যেতে হয় পদে পদে।
পালিয়ে গিয়েও বেঁচে যায়নি মুনমুন। পথে পথে তাকে শিকার হতে হয়েছে অগণিত মানুষ রূপী জানোয়ারদের। মেয়েদের জন্য পৃথিবী কত ভয়ংকর তা নিজের চোখে, নিজেকে দিয়ে জেনেছে মুনমুন। ডানে গেলে কারো হিংস্র দৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে তো বামে গেলে কারো হিংস্র থাবা ছোবল বসাতে চেয়েছে তার গায়ে। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে পথেই বসে পরে মুনমুন। আর নিজেকে টানতে পারছিল না সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। একটু পানি বড্ড প্রয়োজন।
“নে পানি খা।”
আচমকা কারো কন্ঠ ও বাড়িয়ে ধরা পানির বোতল দেখে চমকে ওঠে মুনমুন। পাশে তাকিয়ে ঝলমলে রঙিন পোশাক ও গাঢ় টকটকে লিপস্টিক মাখা মেয়েটাকে দেখে মাথার ভেতর যেন চক্কর দিয়ে উঠল মুনমুনের।
“কিরে পানি খা।”
মেয়েটার আবার পানি খেতে বলার কথায় দ্বিতীয় দফা মাথা চক্কর দেয়ার আগেই পানির বোতল নিয়ে গটগট করে টেনে সবটা পানি শেষ করে দেয় মুনমুন। তবু যেন তার বুকের তৃষ্ণা মিটেনি। তা বুঝতে পেরে মেয়ে বলল, “কিরে আরও পানি খাবি?”
মুখে কিছু বলল না মুনমুন। কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। মেয়েটা উঠে গিয়ে রাস্তার অন্যপাশের দোকান থেকে একটা এক লিটারের ঠান্ডা পানির বোতল কিনে এনে মুনমুনের হাতে দিয়ে তার পাশে বসে পরলো আগের ন্যায়। মুনমুন বুক ভিজিয়ে পানি খেল। যেন কতকালের তৃষ্ণা তার। মুনমুনের খাওয়া হতেই সে জোরে জোরে দুবার নিঃশ্বাস ছেড়ে অবাক নয়নে মেয়েটার দিকে তাকায়। নিজের শরীরের অপ্রীতিকর স্থানে চুলকাতে চুলকাতে মেয়েটা মুনমুনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চাইয়া রইছোছ ক্যা?”
মুনমুনের ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই। মেয়েটা নিজেই আবার বলল, “আমার মরণের সময় তো কেউ আছিল না মুখে শেষবারের মতো পানি দিতে ভাবলাম তোরে অন্তত দেই।”
“মরনের সময়!” বেশ অবাক হয় মুনমুন। মেয়েটাকে তাকে অবাক হতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমারে দেইক্ষা কী মনে হয় আমি বাইচ্চা আছি? এডারে বাইচ্চা থাকন কয়? নিঃশ্বাস নিলেই কী মানুষ বাঁচে?”
মুনমুনের জবাবের অপেক্ষা না করে মেয়েটা নিজেই বলে চলল, “হুন, মাইয়া মানুষ হইল খোলা সিন্ধুকের মতো। খোলা পাইলেই মাইষে হাত সাফ কইরালায়। একদিন আমি তোর জায়গায় আছিলাম। এই দুনিয়া ডা বহুত কঠিন জায়গা রে এনে বাইচ্চা থাকনের একটাই রাস্তা। পায়ের তলে পিইস্সা মারতে হইব ঐ জানোয়ারগুলারে নাইলে ওরা তোরে চুইসা খাইবো দিন রাইত। হয় মরবি না হয় মারবি।”
মুনমুন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টির আকুতি বুঝতে পেরে মেয়েটা বলল, “এই দুনিয়ায় কেউ কারো লেইগ্যা মায়া করে না বুঝলি? মায়া বড় খারাপ জিনিস। মায়ার নাম কইরা মাইনষে ইজ্জতে হাত দেয়। ওগো হুদা শইল চাই, শইল। নিজের ভিত্তের জ্বালা মিডাইতে। দুনিয়াডা বুজে ব্যবসা, বুঝলি? হয় দুনিয়া তোর লগে ব্যবসা করব নাইলে তুই দুনিয়ার লগে ব্যবসা করবি। তয় ব্যবসা হইব এইডাই নিয়ম। এই দেহস না আমারে। প্রথম দুনিয়া আমার লগে ব্যবসা করছে। এহন আমি দুনিয়ার লগে ব্যবসা করি। তয় ব্যবসা কিন্তু বন্ধ নাই।”
মেয়েটা বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল, “জাই গা আমার ধান্দার সময় হইয়া যাইতাছে। বাইচ্চা থাকলে আবার দেহা হইব।”
বলেই মেয়েটা সামনের রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করে। মুনমুনের মাথার ভেতর মেয়েটার বলা কথা গুলো মাছির মতো ভনভন করতে লাগল। তাহলে কী সে আর এই পৃথিবীতে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারবে না? আবার নিজের বোনকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না? এর চাইতে তো তার ফাঁসি হয়ে গেলেই ভালো ছিল। বেঁচে যেত সে। এখন এই জীবন নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে সে? কার দুয়ারে যাবে? তাহলে তাকেও কী পঁচে মরতে হবে এই শহরের নষ্ট গলিতে?
মুনমুন মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে তার পাশে বসে থাকা মেয়েটা শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার কোমড়টা দু’পাশেই দোল খাচ্ছে। অদ্ভুত তার পদক্ষেপ। আচমকাই মুনমুন নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার পিছন পিছন হাটতে লাগে।
বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর মেয়েটা বুঝতে পারে তার পিছনে কেউ আছে৷ থেমে গিয়ে পিছন ফিরে মুনমুনকে দেখে তার কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটা। এসেই বাজখাঁই কন্ঠে বলল, “আমার পিছন আহোস ক্যা?”
এবার মুখ খুলে মৃদু কন্ঠে মুনমুন বলল, “আমি কী আর সেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারব না?”
মুনমুনের প্রশ্নে হেসে দিয়ে মেয়েটা বলল, “আমিও চাই ছিলাম পারি নাই।”
“কেনো?”
“দুনিয়া দেয় নাই। দুনিয়ার চাই আমার শইল।”
থমথমে কন্ঠে মুনমুন বলল, “কোথায় যাবো আমি?”
কিছু একটা ভেবে মেয়েটা মুনমুনের হাত ধরে বলল, “আয় আমার লগে।”
.
চলবে…

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads