পতিতা পর্ব-৯ | Potita -9 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

টুনি- মা গো আমি আইছি মাআআআ….. মাআআআআ……

টুনি মা মা করে চিৎকার করে ঘরের সামনে গিয়েই থমকে যায়। ঘরের দরজা টা লাগানো। তালাটার দিকে তাকিয়ে থেকে টুনি পিছনে ঘুরে আমার দিকে তাকায়। আমার কাছে এসে বলল।

টুনি- আমার মা কই???

বলেই টুনি এদিক সেদিক দেখতে লাগল।

টুনি- মা গো তুমি কই মা। আমি আইছি মা। তোমার টুনি আইছে। ও মা তুমি কই মা। মাআআআ

বাড়ির ভেতরের কোথাও টুনির মাকে পাওয়া গেলো না। হতাশ হয়ে মেয়েটা আমার কাছে এসে দাড়ালো।

রেনু- মনে হয় বাহিরে কোথাও গেছে।

টুনি- ছমিরন দাদী।

বলেই টুনির মুখে হাসি ফুটে উঠল।

রেনু- সেটা আবার কে???

টুনি- আসেন আমার সাথে।

টুনি আমার হাত ধরে আমাকে টেনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়ির ভেতর ডুকলো।

টুনি- ছমিরন দাদী ও দাদী। দাদী তুমি কই???

বাড়ীর ভেতর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এলো।

-কেডা আপনে???

টুনি- এই বাড়িটা ছমিরন দাদীর না???

– হো তয় আপনে হেরে কেমনে চিনেন??? কে আপনে???

টুনি- আমি টুনি।

– আপনে টুনি??? পাশের বাড়ির হেই ছোট্ট টুনি??? কত শুনছি আপনের কথা।

টুনি- ছমিরন দাদী কই???

– আছে আহেন আমার লগে আহেন। বয়স হইছে তো বিছনা থেইকা উঠতে পারে না৷ আমার লগে আহেন।

বলতে বলতেই মহিলা টুনির হাত ধরে ভিতরের ঘরে নিয়ে যায় সাথে আমি আর রতন ভাইও যাই৷

– ও মা মা উডেন। দেহেন কে আইছে।

ছমিরন দাদী- এ্যা কেডা কে আইছে।

– ঐ যে আপনের টুনি। টুনি আইছে মা।

ছমিরন দাদী- এ্যা কি কইলা। টুনি আইছে আমগো টুনি।

বলতে বলতেই ছমিরন দাদী পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকালেন। অনেক বয়স্ক মানুষ তাই বিছানায় পরে গেছে। ব্যবহারে বুঝা গেলো ঐ মহিলা ছমিরন দাদীর পুত্রবধু হবেন। টুনির কথা শুনে হাজার কষ্ট হলেও ছমিরন দাদী উঠে বসলেন।

ছমিরন দাদী- কই টুনি আয় আমার কাছে আয় কত বছর তোরে দেহি না। কত বড় হইয়া গেছে আমগো টুনি।

টুনিকে পেয়ে উনি অনেক আবেগ প্রবন হয়ে গেলেন। কেঁদেই দিলেন।

ছমিরন দাদী- কত বড় হইয়া গেছে আমগো টুনি৷ হেই যে দেখছিলাম ফরগ পইরা কুতকুত খেলতি, গাছে উঠতি, মাডে খেলতি।

টুনি- দাদী আমার মায় কো??? ঘরে তালা কেন??? মায় কই গেছে???

ছমিরন দাদী- টুনিরেএএএ…..

টুনি মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই ছমিরন দাদী টুনিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। টুনির ভেতরের উত্তেজনাটা বেড়ে গেলো মায়ের জন্য। আমার ভেতরে হুট করেই একটা ভয় জেগে উঠল।

টুনি- কও না দাদী মায় কই??? আমার মায় কো???

ছমিরন দাদী- গেরামের হগ্গোলে মিল্লা তোরে কত খুজলাম কোনো হানে পাইলাম না রে টুনি তুই কই হারায় গেলি৷

টুনি- দাদী সব কমু তুমি আগে কও আমার মায় কই??? আমি মার কাছে যামু।

ছমিরন দাদী- টুনিরে তোর মায় মইরা গেছে রে টুনি তোর মায় মইরা গেছে…..

টুনিটা যেনো নিমিষেই স্তদ্ধ হয়ে গেলো। আমিও তো এমনটা আশা করি নি৷ কত আশা নিয়ে এসেছিলাম মা মেয়ের পূর্নমিলন দেখবো বলে। কল্পনায়েও ভাবি নি এসে এমন কিছু শুনতে হবে। ছমিরন দাদী কান্না করতে করতেই বললেন।

ছমিরন দাদী- যেদিন তুই হারায় গেলি ঐ দিন তোর বাপে এক ব্যাডার কাছে তোর মায়েরে বেইচ্চা দিছিলো। তোর মায় কতো হাত পাউ ধরলো তোর বাপের কিন্তু জানোয়ারডায় হুনলো না তোর মার কথা। কষ্টে, দুঃখে, অপমানে ঐ দিন রাইত্তে আমি তোর মায়রে ডাকতে গেছি। সারাদিন কিছু খায় নাই। ও টুনির মা ঘরে আছো নি মা। কিছু তো খাও নাই। আমার লগে আহো মা।

(কইতে কইতেই ঘরের ডুকছিলাম। ঘরের দরজা ডা খোলাই আছিলো। ডুইক্কা দেহি তোর মায় গলায় দড়ি দিছে।) আল্লাহ গো কে কই আছোছ শিগগিরি আয় টুনির মা কি করলি এডা।

বলতে বলতে ছমিরন দাদীর কান্না যেনো বেড়েই চলেছে।

ছমিরন দাদী- ঐ হাতে তোর মার লাশ টা ধরছিরে আমি। তোর জানোয়ার বাপটার লেইগা গলায় দড়ি দিয়া মইরা গেলো তোর মায়। আল্লাহ আমারে মনে হয় তোর লেইগাই বাঁচায় রাখছিলো রে টুনি৷

টুনি- আমি মার কাছে যামু দাদী।

ছমিরন দাদী- ও বউ টুনিরে ওর মার কবর ডা দেহায় দেও।

ছমিরন দাদীর ছেলের বউ আমাদেরকে টুনির মার কবরের কাছে নিয়ে গেলো। টুনিদের বাড়ির পিছনে কবর দেয়া হয়েছে। সেখানে দুইটা করব। মনে পরল টুনি বলেছিলো ওর দাদীর কথা আরেকটা কবর হয়ত টুনির দাদীর। টুনি ওর মায়ের কবরের সামনে গিয়ে বসে পরল। আমি ধরলাম না বাঁধাও দিলাম না। টুনির এখন হালকা হওয়া প্রয়োজন।

টুনি- মাগোওওও…. আমি আইছি মা। মা তোমার টুনি আইছে।

বলেই টুনি কবরের উপর মাথা টা রাখলো। টুনির চোখের পানিরা তো বাধ মানছেই না সাথে আমার চোখের পানি গুলোও কথা শুনছে না। তবে আমার মাকে বলা মিথ্যা স্বার্থক হলো। আমি স্পষ্টভাবে মা আর মেয়ের পূর্ণমিলন দেখছি। বাস্তব না হলেও আত্মার মিলন দেখতে পারছি আমি।

অনেকক্ষণ মায়ের কবরের পাশে থাকার পর টুনি উঠলো। টুনি মায়ের ঘর ঘুড়ে দেখালো আমাকে। যে ঘরে ওর মায়ের কোলে শুয়ে কত সময় পার করেছে। দাদীর সাথে ঘুমিয়েছে। টুনি ওর মায়ের পুরনো কিছু সৃত্মি নিয়ে নিলো।

রেনু- টুনি

টুনি- জ্বি

রেনু- আজকের দিনটা না হয় থেকে যাই।

টুনি- না মাই যখন নেই আর থেকে লাভ কি??? আমার বাড়িটা খালি। এই ৮ বছরে তো ঐ বাড়িটার বাহিরে থাকি নি কখনো। আর স্যারও তো আমার ভরসায় রেখে গেছেন সব।

রেনু- ঠিক আছে।

আমি রতন ভাইকে বলে দিলাম রাতের টিকিট কাটার জন্য। ঐ বেলা আমরা ছমিরন দাদীর বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের অনেক আদর আপপায়ন করলেন। ছমিরন দাদী টুনির ছোট বেলার কত গল্প বললেন। টুনির মায়ের গল্প বললেন। ছমিরন দাদী অনেক বললেন থেকে যেতে কিন্তু টিকিট করে ফেলায় আর টুনি থাকতে চাইছে না সেজন্য আর থাকা হলো না।

ছমিরন দাদীর ছেলের বউয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সেদিন টুনির বাবা টুনির মাকে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় আর ফিরে আসে নি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তা কেউ বলতে পারে না।

রাতেই আমরা আবার রওনা দিলাম। টুনি সারাদিন অনেক কান্না করেছে। তাই কেবিনে গিয়ে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরল। টুনি ওর মায়ের একটা অনেক পুরোন কাপড় বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। যেনো মাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।

আজো একটি নির্ঘম রাত কাটবে আমার। আজ খুব মন চাইছে ঐ মানুষটা যদি এখন সামনে থাকতো। তার সাথে মনের কষ্ট টা শেয়ার করতাম। কি সব ভাবছি আমি। যার সাথে কথাই বলি না তার সাথে আবার মনের কথা শেয়ার করবো। ইদানিং ঘুড়ে ফিরে ঐ মানুষটার কথাই মাথায় ঘুড়ে৷

রতন- ম্যাডাম

রেনু- জ্বি রতন ভাই বলেন।

রতন- স্যার ফোন দিয়ে ছিলেন টুনির কথা জানতে চাইলে বললাম টুনির মা মারা গেছেন।

রেনু- হুম। আর কিছু জিজ্ঞেস করেছেন??

রতন- হ্যাঁ।

রতন ভাই হ্যাঁ বলে আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলেন যেনো আমার জিজ্ঞেস করার অপেক্ষায় আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলেই বলবেন। তাই আমিও জিজ্ঞেস করলাম। রতন ভাইয়ের চাহনি দেখে আমারও জানতে ইচ্ছে করছে মানুষটা কি বলেছে আর।

রেনু- কি বলেছে???

রতন- জিজ্ঞেস করল আপনি কি খুব কেঁদেছেন কি না? আর বলল সে জানে আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। আপনার কি খুব মন খারাপ কি না তাই জিজ্ঞেস করলেন।

রতন ভাইয়ের কথা শুনে আমার যেনো চারিপাশটা ঘুড়তে লাগল। যে মানুষটার সাথে মনের তো দূরের কথা নামের কোন সম্পর্ক আমার নেই সে কি না এতো দূর থেকে বসে আমাকে না দেখে এই কথা গুলো বলে দিলো৷ আমি সত্যি কেঁদেছি। অনেক কষ্ট পেয়েছি টুনির জন্য। আর এই মূহুর্তে আমার অনেক বেশি মন খারাপও। রতন ভাই আমাকে চুপ দেখে চলে গেলেন আর কিছু বললেন না।

বাসায় ৩/৪ দিন এর কথা বলেছি তাই আর বাসায় গেলাম না এই বাসায়ই রয়ে গেলাম। টুনি অনেকটাই স্বাভানিক। মাকে না পেলেও মায়ের সম্পর্কে জানতে তো পেরেছে। এখন তো জানে ওর মা আর নেই৷ এটাও একটা তৃপ্তি। এতো দিন তো কিছুই জানতো না।

মানুষটা আমার কাছে একটা রহস্য ছাড়া কিছুই নয়। কেনো যেতে দেয় না সে আমাকে অন্য কারো কাছে?? কেনো এভাবে আগলে রাখতে চায় আমাকে?? কি চায় মানুষটা??

সেই বিকেল থেকে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে অয়ন চৌধুরী। ফোন দেখছে না। রেনুকে দেখছে। রেনুকে না বলে তোলা রেনুর ঘুমন্ত মুখের ছবিটা দেখছে। এতো মায়া মেয়েটার মুখে যে অয়ন চাইলেও চোখ ফেরাতে পারছে না। অজানা এক মায়া জড়িয়ে ফেলেছে অয়নকে রেনুর সাথে। তাই তো সেদিন যখন রেনুকে ঘুমের মাঝে দেখলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো অয়নের কাছে। রেনু পরের দিন যখন আসছিলো না। রেনুর দেড়ি দেখে অয়নের ভিতরে তোলপাড় চলছিলো কেনো রেনুর দেরি হচ্ছে আসতে। পরে ফোন করে জানতে পারে রেনুর অন্য কারো কাছে যাওয়ার কথা। পাগলের মতো ড্রাইভ করে যায় রেনুকে আটকাতে৷ রেনুর অন্ধকার জগৎ এ নিজেকে ঠেলে দেয়াটা অয়ন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তাই তো কারো কাছে যেতে দিবে না অয়ন রেনুকে। কখনো যেতে দিবে না। অয়ন চায় না রেনুর মায়া ছাড়তে। অয়ন প্রবল ভাবে নিজেকে রেনুর মায়ায় বাঁধতে চায়। রেনু কি বাধঁবে অয়নকে নিজের মায়ায়। রেনু কি কখনো বুঝবে অয়নের ভেতরটা???

.

#চলবে……

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads