পতিতা পর্ব-৪ | Potita -4 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

চোখ বন্ধ করতেই কানে শুনতে পেলাম “রেনু, আমি অয়ন। অয়ন চৌধুরী”। কখন যেনো ঘুমিয়ে পরলাম। আজ বিকেল বিকেলেই ঘুম ভেংগে গেলো আমার। নিজেকে খুব ফুরফুরে লাগছে৷ জানি না কেনো তবু ভালো লাগছে নিজের কাছে। উঠে মুখ-হাত ধুয়ে ছাদে চলে গেলাম। আজ রোদ নেই। হালকা মেঘলা আকাশ সাথে মৃদু বাতাসও বইছে। আমি চুল গুলো ছেড়ে ছাদের রেলিংটা ঘেষে দাড়ালাম। মৃদু বাতাসে আমার চুলগুলো দোল খেতে লাগলো। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। যেনো প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে আমার ভেতরটাকে ঠান্ডা করে দিয়ে যাচ্ছে।

আজ অনেক অনেকদিন পর আমি এভাবে উপভোগ করছি৷

যখন আমার মন ভালো থাকে তখন আন মনেই আমার মুখ দিয়ে গান বেরিয়ে আসে। যেমন এখন আমি গাইছি।

আমারো পরাণোও যাহা চায়….

তুমি তাই তুমি তাই গো.. আমারো পরানো যাহা চায়য়য়….

মা- বাহ কত দিন পর আমার মেয়ে গান গাইছে।

মার ডাকে আমি ফিরে এলাম আমার ভাবনার যগৎ থেকে। মাকে দেখে হেসে দিলাম।

মা- থামলি কেনো গা

রেনু- আবার অন্য একদিন গাইবো।

মা আমার দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো।

মা- এই নে চা।

রেনু- তুমি কিভাবে বুঝলে???

মা- আমার মেয়েটা আমাদের সব প্রয়োজন দেখছে আর আমি তার এতোটুকু প্রয়োজন বুঝবো না??? তা না হলে কিসের মা হলাম।

কথাটা বলেই মা পাশে রাখা চৌকিটাতে বসলেন। মাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার হয়ত মন খারাপ। আমিও গিয়ে মার পাশে বসলাম।

রেনু- কি গো মা কি হয়েছে???? কি ভাবছো???

মা- জানিস তো মা খুব খারাপ লাগে তোদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। তুই একাই কত কষ্ট করছিস।

আমি মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম।

রেনু- দেখো মা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা অনেক ভালো থাকবো।

বিকেলটা আমি ছাদের এই কোণাটায় বসেই কাটিয়ে দিলাম। ছাদের সাথে আমার সম্পর্ক টা অনেক নিবিড়। বিকেলের এই সময়টা আমি এখানেই কাটাতে ভালোবাসতাম। আজ অনেক দিনপর আবার এভাবে সময় কাটাচ্ছি। আবার এভাবে কখনো নিজেকে সময় দিতে পারবো ভাবি নি।

বিকেল ঘনিয়ে কখন যেনো সন্ধ্যা হয়ে চারিদিক কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন হয়ে এসেছে খেয়ালই করিনি। মায়ের ডাকেই আমার খেয়াল হলো।

রেনু- আসছি মাআআআ…

রেনু- ডেকে ছিলে মা???

মা- সন্ধ্যা হয়ে গেছে খাওয়া লাগবে না তোর??

রেনু- খাবো তো।

মা- কখন খাবি শুনি???

রেনু- তুমি যখন দিবে তখনি।

বলেই হেসে দিলাম।

মা- যা তোর বাবার কাছে গিয়ে বস। আমি খাবার নিয়ে আসছি।

আমি বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখলেই বাবার মুখে সুখের হাসি ফুটে উঠে। এই হাসিটা দেখলেই আমি আমার সব কষ্ট ভুলে যাই৷

রেনু- বাবা তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেই???

বাবা- নারে মা লাগবে না।

রেনু- বললেই হলো লাগবে না। কতদিন তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেই না।

বলতে বলতেই বাবার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে খুব যত্ন করে তেল দিয়ে দিতে লাগলাম।

তখনি মা আসে ভাত নিয়ে।

মা- সেকি মেয়েটা সারাদিন কিছু খায় নি এখন একটু খাবে। আর তুমি ওকে দিয়ে মাথায় তেল দেয়াচ্ছো???

রেনু- মা তুমি বাবাকে এভাবে বলবে না৷ আমি বলেছি দিয়ে দিবো।

মা- ভাতগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে যে মা।

রেনু- তাহলে তুমি খাইয়ে দাও। কতদিন তোমার হাতে ভাত খাই না।

মা আজ অনেকদিন পর আমাকে ভাত খাইয়ে দিলো। আজ পেটের চাইতে মনটা ভরলো বেশি৷ মায়ের হাতে ভাত খাওয়া সুখটাই অন্যরকম।

রেনু- মা আমি যাই আমাকে আবার বের হতে হবে।

বাবা- রেনু মা

রেনু- কিছু বলবে বাবা???

বাবা- একটা কথা বলতাম।

রেনু- বলো না বাবা কি বলবে।

বাবা- বলছিলাম কি তুই অফিসে বলে দেখতি যদি তোকে সকালের সিফটে দেয়া যায়। এভাবে রাত জেগে কাজ করলে তো তুই অসুস্থ হয়ে পরবি মা।

আমার জন্য বাবা কত চিন্তা করে৷ ভেতরে ভেতরে অনেক অপরাধবোধ কাজ করে আমার। পারছি না তাও সহ্য করা লাগছে। কারণ সত্যি টা জানলে যে আমার বাবা মা মরে যাবে।

বাবা- কিরে মা কি ভাবছিস?

রেনু- মাত্রইতো জয়েন করলাম কিছুদিন যাক তারপর না হয় বলে দেখবো।

বাবা- আচ্ছা যা মা তৈরি হয়ে নে।

৮টার মাঝেই আমি বেরিয়ে পরলাম। রাস্তায় জ্যামও থাকে এতোটা পথ যেতেও তো সময় লাগবে৷ ভাবছি আর হাটছি। হাটতে হাটতেই গলির মড়ো এসে থমকে গেলাম। আমি ঠিক দেখছি তো। চোখ বন্ধ করে আবার তাকালাম। নাহ ঠিকি দেখছি। মানুষটা গাড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে কাছাকাছি আসতে দেখেই সে গাড়ি থেকে নামলেন। আমি তার সামনে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। তাকে কি বলবো। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে নিজেই বললেন।

অয়ন- তুমি তো সকালে এখানেই নামলে বাসা তো চিনি না তাই ভাবলাম হয়ত এখান দিয়েই আসবে তাই এখানেই অপেক্ষা করলাম।

আমি কিছু বললাম না। সে আমাকে আবার অবাক করে দিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দাড়ালেন।

অয়ন- বসো।

আমি তার বাধ্যগত ভাবে বসে পরলাম।

সে আমাকে নিয়ে বাসায় চলে এলেন।

টুনি আমাকে দেখেই হেসে দিলো।

আমি তার রুমে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষা তো বাহানা আমি তো তার চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। তার আচরণ গুলো কিছুতেই মিলাতে পারছি না৷ সে কখন পাথরের মতো শক্ত কখন পানির মতো সচ্ছ কিছুতেই বুঝতে পারি না। তার হিসেবটা যে কিছুতেই মিলাতে পারি না৷ সে কেনো আমার বোঝার বাইরে। কেনো পারাছি না আমি তাকে বুঝতে। তখনি সে আসল। তার সাথে আরো দুজন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা সার্ভেন্ট।

অয়ন- এই ব্যাগটা আর বাকি জিনিস গুলো নিয়ে গাড়িতে রেখে দাও।

তারা ব্যাগ আর বাকি জিনিস নিয়ে চলে গেলো। মানুষটা আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম। তার চাহনিতে কি যেনো আছে৷ আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

অয়ন- আমি বিজনেসের কাজে দেশের বাহিরে যাচ্ছি ফিরতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আর আমি না ফেরা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে। অন্য কারো কাছে যাবে না বলে দিলাম। ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে আসবে আবার সকালে দিয়ে আসবে। কথার যদি এদিক সেদিক হয় তাহলে সেখানেই শেষ করে দিবো। কথাটা মনে থাকবে তো???

আমি মুখে কিছু বললাম না শুধু মাথা ঝাকিয়ে সায় দিলাম মনে থাকবে।

অয়ন- এটা রাখো এখানে যা আছে তা দিয়ে আমি আসা পর্যন্ত তোমার চলতে কোন সমস্যা হবে না। আর যতদিন আমি না আসবো প্রয়োজনে প্রতিদিন তুমি রাতে এখানেই থাকবে৷ আমি ফোন দিয়ে খবর নিবো কথার যেনো নড়চর না হয়। আমি আসি। সাবধানে থেকো।

আমি দাড়ানো থেকে বিছানায় বসে পরলাম। সে আমাকে কথা গুলো বলেই বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন। হুট করেই সে আমার একদম কাছাকাছি চলে এলেন। মাথা নিচু করে আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিলেন। আর বললেন।

অয়ন- নিজের খেয়াল রেখো।

বলেই একট হাসি দিয়ে সে বেরিয়ে গেলেন৷ আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কি হলো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। নিজের অজান্তেই আমার হাতটা কপালে চলে গেলো। সে আমার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলেন।

হ্যাঁ, এটা ভালোবাসার পরশ। কারণ এই মানুষটার প্রতিটা স্পর্শের সাথে আমি পরিচিত। তার এই স্পর্শে কোন রাগ ছিলো না, কোন ক্ষোভ ছিলো না, শুধু ছিলো শুধু ভালোবাসা তাই এটাকে ভালোবাসার পরশ বলে। আমি ভূত দেখার মতো বসে রইলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পর এক কাপ চা হাতে টুনি এলো।

টুনি- আপনার চা।

রেনু- এতোক্ষণ কোথায় ছিলে??

টুনি- স্যারের স্টাডি রুম গোছাচ্ছিলাম। সারাদিন কাজ করেছেন তো তাই এলো মেলো হয়ে ছিলো। স্যার প্রতিবারই কোন বিজনেস টুরে যাওয়ার আগে এমনটা হয়।

রেনু- টুনি একটা কথা জিজ্ঞেস করি???

টুনি- জ্বি বলেন।

রেনু- তোমার স্যার অনেক বড়লোক তাই না।

টুনি- কি হবে এতো টাকা দিয়ে বলেন মানুষটাকে ভালোবাসারই তো কেউ নেই। ভালোবাসার বিনিময়ে শুধু পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা। এতো টাকার কি মূল্য।

আমি স্পষ্ট দেখলাম কথা গুলো বলতেই টুনির চোখ ছলছল করছিলো। তাই প্রসঙ্গ পালটে দিলাম। আর কিছু জানতে চাইলাম না।

রেনু- তোমার সাথে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে।

টুনি- আমারও আপনাকে খুব আপন মনে হয়।

রেনু- তাহলে আজ সারারাত তুমি আর আমি গল্প করব।

টুনি- এই তো গল্প করছি।

রেনু- করছি আরো করব সারারাত।

কথা বলতে বলতেই আমার চায়ের কাপটা খালি হয়ে গেলো। টুনি আমার হাত থেকে কাপটা নিয়ে নিলো।

টুনি- এবার লক্ষি মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পরুন।

রেনু- সেকি কথা আমরা তো গল্প করব।

টুনি- করব তবে আজ নয়। স্যার বলে গেছেন আজ যেনো আপনি ঠিক মতো ঘুমান। আপনার বিশ্রাম দরকার। তাই আজ আর রাত জাগা যাবে না।

বলেই টুনি আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার গায়ের উপর চাদর টা টেনে দিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে চলে গেলো।

আমি চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো কেউ আলতো করে আমার কপালে চুমু এঁকে দিলো। আমি চোখ খুলে ফেললাম। নাহ এটা শুধু আমার ভাবনা ছিলো। যখন মানুষের সাথে তার চিন্তা-ভাবনার বাহিরে কিছু ঘটে তখন ঐ ঘটনাটাই বার বার মাথায় ঘুড়ে আমার সাথেও তাই ঘটেছে। সেজন্যই আমার মস্তিষ্কে সেই ঘটনাটার পূণরাবৃত্তি ঘটছে। কারণ ঐ মানুষটার থেকে এমন কিছু আমি আশা করা তো দূরের কথা কল্পনায়েও ভাবি নি অথচ সেটাই হয়েছে আমার সাথে।

আজ অনেক গুলো দিন পর আমার ভিতরটা শান্ত তাই হয়ত সারাদিন ঘুমানোর পরেও এখনো আমার চোখে রাজ্যের ঘুম। মনে হচ্ছে কেউ আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘুমের দেশে রাজ্যত্ব করতে। হয়ত সেটা অয়ন চৌধুরী ব্যতীত অন্য কেউ নয়।

 

.

#চলবে………

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads