পতিতা পর্ব-১৮ | Potita -18 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

বাড়ির নাম হবে তিনকন্যা নিবাশ। শেষে কোন উপায় না পেয়ে বাবাকে সেই জমি বিক্রি করতে হয়। সেদিন জীবনে প্রথম আমি আমার বাবাকে কাঁদতে দেখেছি।

সেদিন সারারাত আমিও কেঁদেছিলাম। আমার বাবার চোখের পানি দেখে। আমি তখন অনার্স শেষ বর্ষে পড়ি। চাচা চলে গেলেন বাবাও একা হয়ে গেলেন৷ জীবনে প্রথম আমার আফসোস হলো আমি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতাম তাহলে আমার বাবাকে নিজের ভাই দ্বারা প্রতারণার শিকার হতে হতো না। খুব কেঁদেছিলাম আমি সেদিন। আমার বাবা আমাকে কখনো টিউশনি করতে দেয় নি। আমার এখনো মনে আছে আমি সদ্য এসএসসি পাশ করে ভালো রেজাল্ট নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। আমাদের পাশের বাসার সানোয়ারা আন্টি আমাকে বললেন তার ছেলেকে পড়াতে। লক্ষি একটা ছেলে ছিলো তামিম। আমার অনেক ভক্তও ছিলো। আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম এটা ভেবে আমি কাউকে পড়াবো। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। কোন মতেই সে চাইতেন না ঐটুকু সময় আমার কাঁধে কোন দায়িত্ব আসুক। প্রথমে বাবার নিষেধে কষ্ট পেলেও পরে বাবার কথা শুনে আমি নিজেই কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার বাবা আমাদের অনেক ভালোবাসতেন। যখন যেটা প্রয়োজন সেটা করেছেন। তখন বাবার এ অবস্থা দেখে বাবাকে না বলে চুপি চুপি টিউশনি খোজা শুরু করলাম। পেয়েও গিয়েছিলাম দুইটা টিউশনি। দুইটা টিউশনিতে মাসে সাত হাজার টাকা পাবো। কিন্তু বাবা মাকে না জানিয়ে কিভাবে করব। বাবাকে বললে বাবা অনুমতি দিবে না তাই মাকে বললাম। প্রথমে মাও রাজি হতে চায় নি৷ সামনে আমার পরীক্ষা এটাই শেষ বছর। যদি টিউশনি করতে গিয়ে পড়ার ক্ষতি হয়৷ অনেক কিছু বুঝালাম মাকে। কিছুতেই রাজি হতে চাইছেন না মা।

মা- এই কয়টা টাকায় তোর ভার্সিটির খরচ হবে না রেনু। আর তোর বাবা তো দিচ্ছে। পড়াটা শেষ করে না হয় প্রয়োজন হলে ভালো একটা চাকরী করিস।

রেনু- মা আমি জানি এই কয়টা টাকায় কিছু হবে না। তাও দেখো আমার প্রতিদিন এতো গুলো টাকা খরচ হয়। অন্তত আমি সেই খরচ টা তো চালাতে পারবো। আর বাবা যে টাকা দিবে তা তুমি নিজের কাছে রেখে দিও এতে কিছু টাকা তো সেভ হবে মা।

মা- তোর সারাদিন ক্লাস থাকে কখন পড়াবি তুই?

রেনু- ক্লাস নিয়ে কোন সমস্যা নেই মা। দুইটা টিউশনিই আমার ভার্সিটির কাছে। একজন কে সকালে পড়াবো ক্লাসের আগে আরেকজনকে দুপুরে পড়াবো। ক্লাসের মাঝে তো আমার গেপ থাকেই সে সময় পড়িয়ে নিবো। তুমি চিন্তা করো না মা।

মা- নিজের পড়া তার উপর আরো দুজনের দায়িত্ব নিতে পারবি তুই। এদিকে অনু তনুকেও তো তোরই দেখা লাগে।

রেনু- মা বেশ পারবো। তুমি একদম চিন্তা করো না। বাড়তি তো কিছু না সিলেবাসের পড়াটাই তো পড়াতে হবে। আর আমার অনু তনুকে আমি ঠিক সামলে নিবো। ওদের তো মাঝ রাতেও পড়াতে পারবো মা।

মা- তুই সত্যি পড়াবি??? তোর বাবা জানতে পারলে কষ্ট পাবে।

রেনু- আমি যদি তোমাদের মেয়ে না হয়ে ছেলে হতাম তাহলে কি তোমরা আমাকে তোমাদের জন্য কিছুই করতে দিতে না???

মা আর কিছুই বলতে পারে নি। শুধু বলেছিলো সে সময় সুযোগ বুঝে বাবাকে বলে দিবে।

ব্যবসাটাকে ধরে রাখতে বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। চাচা যে পিছনে পিছনে বাবার এতো ক্ষতি করে গেছে তা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি নি। বাবার নামে অনেকের থেকে টাকা লোন নিয়ে রেখেছিলো চাচা। একের পর এক পাওনাদাররা বাবাকে কল দিচ্ছিলেন। বাবার মাথায় যেনো আকাশ ভেংগে পরল। কি করবে কোন দিসে পাচ্ছিলো না। চাচার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। সে নিজের প্রয়োজনে লোন নিয়েছে বাবা কেনো দিবে। সে হেসে দিয়ে বলল পেপারে বাবার স্বাক্ষর আছে। আসলেই সব পেপারেই বাবার স্বাক্ষর ছিলো৷ প্রথম প্রথম সব কাগজ পত্র বাবা পড়েই স্বাক্ষর করতেন কিন্তু পরবর্তীতে কাজের প্রতি চাচার এতো ডেডিকেশন দেখে বাবা আর সেভাবে পড়তেন না। চাচাকেই জিজ্ঞেস করতেন কিসের কাগজ শুনেই স্বাক্ষর করে দিতেন। চাচার সাথে যোগাযোগ করে বিশেষ কোন লাভ হয় নি। তখনো বাবা এসব নিয়ে চিন্তা করছিলেন না। বাবার আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিলো। আল্লাহ বিপদ দিয়েছেন আল্লাহই উদ্ধার করবেন আমাদের। মোহাম্মদপুরের পাশেই বসিলাতে আমাদের জমি কিনা ছিলো। আশুলিয়ার জায়গাটা যখন বাবা বিক্রি করলেন তখন নিজেকে এটা বলে শান্ততা দিয়েছিলেন অতো দূরে তো আমাদের গিয়ে থাকাও হবে না এর চাইতে বাড়িটা নাহয় বসিলাতেই করব। আমাদের মেয়েদের জন্ম এখানে ওরা বড় হয়েছে এখানে। এতো দূরে গিয়ে কি ভালো লাগবে ওদের।তার চাইতে সেটাই ভালো হবে। কিন্তু চাচার বৈঈমানির জন্য বাবাকে বসিলার জমিটাও বিক্রি করতে হবে। বাবা কয়েকটা ব্যাংকে লোনের জন্য এ্যাপলাই করে ছিলেন কিন্তু কোথাও থেকে লোনও পাচ্ছিলেন না। তাই বাবাকে বাধ্য হয়ে অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ঐ জমিটা বিক্রি করতে হবে। সেখানে গিয়ে বাবা আরো বড় প্রতারণার খবর পায়। বসিলার ঐ জমিটা যখন কেনা হয় ঐ জমির খবর মূলত চাচাই দিয়ে ছিলেন। চাচার অনেক পছন্দ হয়েছিলো ঐ জমিটা। তাই বাবা বলেছিলো। এখানে বাড়ি করে দিবে চাচা এখানেই থাকবে দেখাশুনা করবেন। কিন্তু জমি বিক্রি করতে গিয়ে বাবা জানতে পারে ঐ জমিটাই নাকি বাবার না। এর আগে তো বাবার মাথায় আকাশ ভেংগে পরেছিলো কিন্তু এই খবর শুনার পর আমার বাবার পায়ের নিচের জমিনটাও যেনো সরে যাচ্ছিলো। বাবা খবর নিয়ে জানতে পারে প্রথমে বাবার নামে কেনা হলেও পরর্বতীতে কিভাবে যেনো চাচা জমিটা নিজের নামে লিখে নেয়। বাবা বুঝতেও পারে নি। আর চাচার সাথে ঐ জায়গার স্থানীয় লোকের হাত আছে। বাবা চাইলেও বেশি কিছু করতে পারবে না। সেদিন বাবা অনেক ভেংগে পরেছিলো। কারণ ঐ মূহুর্তে আমাদের কাছে সম্বল বলতে ঐ জমি টা বাদে আমরা যে ফ্ল্যাটটায় থাকতাম সেটা, মার, আমার, অনু, তনুর গয়না যা ছিলো তাই। এ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। বাবা দাদার যা সম্পত্তি পেয়েছিলো সে সব বিক্রি করেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন আর আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো করেছিলেন। আর মা নানাবাড়ি থেকে অনেক বেশি সম্পত্তি পায় নি তবে যা পেয়েছিলো সেইসব বিক্রি করে তার সাথে আরো টাকা যোগ করে আমাদের এই ফ্ল্যাট টা কিনেছিলেন। বাবা দিন রাত খেটে যাচ্ছেন। কোন ভাবেই কোন উপায় পাচ্ছেন না। ঋণদাররা প্রতিনিয়ত ফোন দিচ্ছে, বাসায় আসছে, পথে-ঘাটে বাবাকে আটকাচ্ছে। বাবার বিপদ বাড়তেই থাকে। কেউ কেউ তো বাবাকে জানের হুমকিও দেয়। মা বাবার এ অবস্থা দেখে সহ্য না করতে পেের চাচিকে কল দেয়। অনেক অনুনয় বিনয় করে।

মা- রাহেলা মাহমুদ কে বুঝাও তোমার ভাইয়ের বিপদ দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। ওকে বলো ঋনদার দের বলতে টাকা তোমার ভাই নেয় নি। এতো গুলো টাকা সে কিভাবে দিবে।

রাহেলা- আমি কি বলবো ভাবি। আমি তো এসব কিছুই জানি না। কিসের টাকা।

মা- ওরা তোমার ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে রাহেলা।

রাহেলা- তাতে আমার কি?? মরলে আপনার স্বামী মরবে এটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আর কখনো ফোন দিবেন না। যত্তসব ছোট লোক।

বলেই চাচি ফোন টা রেখে দেয়। চাচির বলা কথা শুনে মা যেনো কাঁদতেও ভুলে যায়।

বাবা রাতে ফিরলে মা ফ্ল্যাটের দলিল গুলো বাবার সামনে রাখে।

বাবা- এসব কি???

মা- ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে যে যা পাবে দিয়ে দাও।

বাবা- কি সব বাজে কথা বলছো??? সামন্য কটা টাকার জন্য কি নিজের মেয়েদের মাথার উপর থেকে ছাদ কেড়ে নিবো নাকি??? আর আমি তো এখনো বেঁচে আছি নাকি??

মা- আজকে তারা তোমাকে মারা হুমকি দিয়েছে কাল যদি সত্যি সত্যি কিছু করে ফেলে তোমার। তাহলে এই তিনজনকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাড়াবো আমি একবার ভেবে দেখেছো???

বাবা- আরে তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো এমন কিছুই হবে না।

মা- কি হবে না হবে জানি না। তুমি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিবে বেস। আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি থাকলেই আমাদের হবে।

বাবার অনেক বুঝানোতেও মা কিছুতেই শুনবেন না। মা অনেক বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলো৷ আমরা তিন বোন দরজার পিছনে দাড়িয়ে সব শুনছিলাম। তনু তো কান্নাই করে দিয়েছিলো। আমি তনুর মুখ চেপে ধরে ওদের নিয়ে সেখান থেকে চলে যাই। বাবা মাকে রাজি না করাতে পেরে বাধ্য হয়ে ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে দেয়। বাবা অনেক কষ্ট পায় অনেক৷ আমার বাবাটা পাচা স্বভাবের। কখনো নিজের কষ্টগুলো কাউকে বলতেন না। ফ্ল্যাটটা বিক্রি করতে বাবার অনেক কষ্ট হয়েছে। পাওনাদার দের টাকা দিয়ে কিছু টাকা বাবা মার নামে ব্যাংকে রেখে দেয়। আর মাত্র ৫ দিন তার পরেই আমাদেরকে ফ্ল্যাটা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে। মা বাবাকে বলেছিলো বেশি বড় বাসা নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তিন বেডরুমের বাসা নিলেই হবে। অনু তনু ছোট ওরা এক রুমে থাকবে। শুধু রেনু টা বড় হয়েছে ওর নিজের একটা রুম প্রয়োজন। রাতে বাবা কোন রকম খেয়েই উঠে গেলেন। তেমন বেশি একটা কথাও বললেন না। বাবাকে অনেক দুঃখি দেখাচ্ছিলো। আমি বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিলো। সবাই যার যার মতো রুমে চলে গেলাম আর মাত্র হাতে গণা কয়টা রাত তার পর আমাকে আমার এই রুম বাসা সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি দু চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। আমার চোখের ঘুম যেনো কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো। আমার, অনুর, তনুর আমাদের তিনজনেরই জন্ম এ বাসায় হয়েছে। আমাদরে ছোট থেকে বড় হওয়ার সকল স্মৃতি এখানে। ঘুম আসছে না তাই আমি এ্যালবাম খুলে বসলাম। কত স্মৃতি, কত সুখের দিন ছিলো আমাদের। আমার বাবা মায়ের সোনালীদিন। আমার চোখ দিয়ে কখন যেনো পানি বেয়ে পরল। আমি চোখের পানি মুছতে গালে হাত দিতেই শুনতে পেলাম।

মা- রেনুউউউউউউউউউউ

মাঝ রাতে মায়ের চিৎকার। আমার হাত থেকে এ্যালবাম টা পরে গেলো। হঠ্যাৎ করে মায়ের চিৎকার শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। মায়ের চিৎকার বাড়তেই থাকে। আমি দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে দেখি মা বাবাকে ধরে চিৎকার করছে। বাবাকে এমন ভাবে দেখে আমি থর থর করে কাঁপতে লাগলাম।

মা- রেনু দেখ তোর বাবা কেমন করছে। কিছু কর রেনু কিছু কর।

.

চলবে……..

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads