অয়ন চৌধুরী কি সত্যি ওকে নিজের নাম দিবে না??? দূর করে দিবে আমাদের কে????
অয়ন সেই থেকে বারান্দায় বসে আছে৷ একদম ভালো লাগছে না। একদিন রেনুকে দেখেনি বলে নিজেকে অস্থির লাগছে। মেয়েটাকে ইদানিং চোখে হারায় অয়ন। হারাবেই বা না কেনো। অয়নের ছন্ন ছাড়া জীবনটাকে যে নতুন করে বাঁচার মানে দিয়েছে মেয়েটা৷ রেনু যদি রাজি না হয় তাহলে জোর করে হলেও রেনুকে নিজের কাছে রেখে দিবে অয়ন। রেনু যখন ঘুমের মাঝে বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি হয়ে অয়নের বুকে ডুকে যায় অয়ন পরম যত্ন করে রেনুকে বুকে আগলে নেয়। কতরাত এমন হয়েছে৷ রেনু বলতেও পারবে না অয়ন না ঘুমিয়ে রেনুকে বুকে নিয়ে রেনুর নিষ্পাপ চেহারাটা দেখে কাটিয়ে দিয়েছে৷ এতো ভালোলাগা কাজ করে মেয়েটার মাঝে যে প্রথম প্রথম নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাইলেও এখন আর অয়ন চায় না রেনুর থেকে দূরে থাকতে। এখন নিজের সবটা জুড়ে কেবল রেনুকে চায় অয়ন। প্রথম রাতে যখন অয়ন রেনুকে নিজের করে নেয়। নিজের ভুলের জন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলো ভেবে অয়নের অনেক অপরাধবোধ কাজ করে। তাই তো অয়ন চায় নি রেনু এভাবে নিজেকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিক। আর সেজন্যই বার বার রেনুকে আটকেছে। আর রেনুকে বাঁচাতে গিয়ে কখন যে নিজেই রেনুর মায়ায় জড়িয়ে গেছে তা অয়ন নিজেও জানে না৷ প্রথমে খুব চিন্তা হতো অয়ন রেনুকে সুখে রাখতে পারবে তো কিন্তু এখন অয়ন আর তা ভাবে না। এখন অয়নের রেনুকে চাই ই চাই৷ অয়ন জানে রেনু অয়নের কাছেই ভালো থাকবে। একদিন রেনুকে না পেয়ে, না দেখে নিজেকে নিঃস্ব লাগছে অয়নের।
আবার নিজেকে অথই সাগরে অনুভব করছি৷ অয়ন কি আমার অন্ধকার পৃথিবীটাকে আলোকিত করবে না?? কি করবো আমি এখন??? অয়ন তো এমন নয়। যে মানুষটা আমার মতো একটা মেয়েকে চোখে হারায় সে কি নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবে না?? নিজের পরিচয় দিবে না??? আমি মা হয়ে কিভাবে মেনে নিবো আমার সন্তানের মৃত্যু। আর আমার নিজের মা। আমার যে বাবা মা যাদের জন্য আমার এতো কিছু তাদের সামনে গিয়ে কিভাবে দাড়াবো আমি?? কি জবাব দিবো আমি সবাইকে?? সমাজের মানুষের কথার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাবো??? অয়ন যদি অস্বীকার করে আমাকে আমার সন্তানকে। তাহলে সমাজে কিভাবে দাড়াবো আমি ওকে নিয়ে। আমি নিজে মা হতে গিয়ে আমার বাবা মাকে কিভাবে দুঃখে ঠেলে দেই। বাবা দু দু বার স্টক করেছে৷ এই কথা শুনলে যদি বাবা আবার নাহ… যে বাবাকে বাঁচাতে আমি অন্ধকার জগৎ এ নেমেছি সেই বাবাকে আমি নিজের হাতে কিভাবে শেষ করে দেই। আমার বাবাটা এসব শুনলে মরেই যাবে। তাহলে কি মেরে ফেলবো আমি ছোট্ট জানটাকে। আমার মাথা ঘুড়াতে থাকে। আমি কোন কুল কিনাড়া পাচ্ছি না।
আগের থেকে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছি। কথা বলতে মন চাইছে না আমার। কিছুই ভালো লাগছে না। গতকাল যাই নি আজ না গেলে অয়ন সন্দেহ করতে পারে। আর যদি বাসায় এসে উঠে তখন। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও রেডি হয়ে বসে আছি৷
মা- তোর কি বেশি খারাপ লাগছে??
রেনু- না তো মা কেনো???
মা- মুখ চোখ কেমন ফুলে গেছে। ভালো না লাগলে দুদিন ছুটি নিয়ে নে।
রেনু- না প্রয়োজন নেই মা। আমি বের হলাম না হলে আবার দেরি হয়ে যাবে।
মা- সাবধানে যাস।
মা দরজায় দাড়িয়ে রইলেন আমি বেরিয়ে গেলাম। মার মন তো তাই হয়ত জানান দিয়ে দিয়েছে যে তার মেয়ের কিছু হয়েছে। প্রতিটা মেয়ের জীবনে মা হতে পারাটা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক বড় একটা খুশির সময়। কিন্তু আমি না পারছি খুশি হতে আর না পারছি কাউকে বলতে। কিভাবে বলবো। আমার সন্তানকে তো কেউ আর দশটা সন্তানের নজরে দেখবে না। ওকে কিভাবে বাঁচাবো আমি। এখন সব অয়নের হাতে। সেই পারবে আমার সন্তানকে এই সমাজে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে৷ সে অয়ন চৌধুরীর সন্তান।
আজ অয়ন আসে নি আমাকে নিতে। মনে মনে হাজার কথা ভাবছি কি করবো৷ অয়নকে কিভাবে বলবো। অয়ন কি বলবে। মেনে নিবে নাকি ছুড়ে ফেলে দিবে। আজ বাড়িতে ডুকতেই টুনিকে দেখতে পেলাম না। হয়ত কোন কাজে ব্যস্ত। আমি উপরে উঠে গেলাম।
অয়ন- না খালামণি আমি আগেই না করেছি৷ আর কতবার একি কথা বলবে। এ্যাংগেইজমেন্ট হয়েছে তাই বলে যে এখনি বিয়ে করতে হবে তা তো নয়। আর বিয়ের এতো তাড়া থাকলে তখন এ্যাংগেইজমেন্ট না করিয়ে বিয়েই করিয়ে দিতে তাহলে তো এতো নাটক হতো না। না প্লিজ খালামণি তুমি এখন আমাকে বিয়ের কথা বলো না। আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। আমার কিছু দায়িত্ব আছে সেগুলো শেষ না করে আমি কিছুই করব না। আর এসব বলতে আমাকে কল দিও না। রাখছি।
কল টা কেটেই অয়ন ফোনটা ছুড়ে মারে।
আমি পিছনেই দাড়িয়ে ছিলাম অয়ন দেখে নি আমাকে। অয়নের বলা কথা গুলো শুনে যেনো আমি জমে পাথর হয়ে গিয়েছি। তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। টুনিও তো কথাটা কখনো আমাকে বলে নি। তাহলে কি তুবা আপু ঠিকি বলেছে। তাহলে কি অয়নও বাকি দশ জনের মতোই নিজের প্রয়োজন মিটাতে আমাকে আকড়ে আছে??
ফোনটা ছুড়ে মেরেই অয়ন পিছনে ঘুড়তেই আমরা মুখো-মুখি হই। সে কোনো কথা না বলে আমাকে পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। আমি ব্যগটা পাশে রেখে বিছানায় গিয়ে বসে নিজেকে পিছনে এলিয়ে দিলাম। শুয়ে দুপাশে দু হাত ছড়িয়ে দিলাম। আমার চোখ দুটো দিয়ে শুধু পানি পরছে। তুবা আপুর বলা একটা কথা মনে পরে গেলো। আপু বলেছিলো একবার এই অন্ধকার জগৎ এ পা রাখলে পরে আমি ছাড়তে চাইলেই এই অন্ধকার জগৎ আমাকে ছাড়বে না। আমি একটু একটু করে এই অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি।
অয়ন রাগে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তখন মা অসুস্থ থাকায় মায়ের জন্য বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজি হতে হয়েছিলো অয়নকে। না হলে সোহার ঐ প্রতারণার পর আর কারো সাথে নিজেকে জড়াবে না ভেবেছিলো অয়ন। অয়নের খালামণির ভাসুরের মেয়ের সাথেই বিয়ে ঠিক হয় অয়নের। তখন অয়নের মা অসুস্থ হওয়ায় কেবল এ্যাংগেইজমেন্টটাই হয়। কিন্তু এখন তারা চাচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাক। অয়ন যদি জানতো অয়নের জীবনে কোন রেনু আসবে তাহলে কখনোই অয়ন ঐ বিয়ে টার জন্য রাজি হতো না। তবু যাই হোক রেনু ছাড়া অন্য কাউকে অয়ন নিজের জীবনে জায়গা দিবে না। তাই আর দেরি করা যাবে না৷ দায়িত্বগুলো সম্পাদন করেই অয়ন রেনুকে নিজের করে নিবে বলেই অয়ন গাড়ি ঘুড়ায় রেনুর কাছে যাবে বলে।
বাসায় ফিরে এসেই দেখে রেনু ঘুমিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ লাগছে দেখতে। অয়ন পারে না চোখ ফেরাতে আর চায়ও না চোখ ফেরাতে তাই অপলক তাকিয়ে আছে এই মায়াবতীর পাণে। রেনু ঘুমের মাঝে গুটিশুটি হয়ে কিছু খুজতে থাকে। অয়ন বুঝে যায় রেনু অয়নের বুকটা খুজছে তাই অয়ন আর অপেক্ষা না করে রেনুকে যত্ন করে নিজের বুকে নিয়ে নেয়। এভাবেই সারাটা জীবন অয়ন রেনুকে বুকে আগলে রাখতে চায়। অনেক বেশি ভালোবাসতে চায়। রেনুকে নিয়ে নিজের সুন্দর জীবন শুরু করতে চায়। ছোট ছোট হাত পা আসবে যে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াবে আর অয়নকে বাবাই বাবাই বলে পাগল করে ফেলবে। সেটা অয়নের অংশ রেনুর গর্ভে আসবে। সব সুখ দিতে চায় অয়ন রেনুকে। এসব ভাবতেই অয়নের কি পরিমান খুশি লাগছে আর যখন সত্যি রেনু অয়নের বউ হবে ওর সন্তানের মা হবে অয়ন তো খুশিতে পাগলই হয়ে যাবে৷ আর তর সইছে না অয়নের। অয়ন আবার সুন্দর করে বাঁচতে চায় রেনুকে আকড়ে ধরে।
যে সুখের জন্য অয়ন দিন গুণছে সে সুখ যে অয়নের ধরা দিয়েছে তা সে জানতেই পারে নি এখনো।
সকালে।
বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। অয়ন ঘুম থেকে উঠে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আমার ঘাড়ে নিজের নাক ঘষলো।মাতাল করা অনুভূতি। আমি যেনো কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। এই সুখগুলো বিধাতা কেনো আজীবনের জন্য আমার কপালে লিখে দেয় নি। কেনো???
অয়ন- একটা কথা বলি???
রেনু- বলেন।
অয়ন- আমি তোমাকে এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে চাই।
আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অয়ন- আমি জানি তুমি তোমার পরিবারের জন্য সব কিছু করছো আর সেটা যদি তোমার হয়ে আমি করে দেই। দায়িত্বটা যদি আমি পালন করি।
তার মানে ফোনে সে এই দায়িত্বের কথাই বলছিলেন। তাহলে কি সে আমার থেকে মুক্তি চায় সেজন্য এসব করতে চাইছেন। আমার কাছে কি তার প্রয়োজন শেষ। মনে মনে ভাবতে লাগলাম।
অয়ন- তোমার সময় লাগলে তুমি সময় নাও। ভেবে আমাকে জানাও। তুমি যেভাবে চাও আমি সব সেভাবেই করব।
উনার কথা শেষ করে সে আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিলেন। আমি বাসায় চলে এলাম।
তার বলা কথাগুলোই বার বার আমার মাথায় খেলছে। সে আমার হয়ে সব করতে চায়। কিন্তু কেনো??? সেটা কি শুধু মাত্র আমাকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য নাকি সে নিজে আমার থেকে মুক্তি চাই নাকি আমার প্রতি করুনা করছেন?? বাচ্চাটার কথা তাকে বলেই বা কি হবে। হয়ত বলবে এবোর্শন করিয়ে নিতে। কিন্তু আমি তা পারবো না। সে তো আরেক জনের বাগদত্তা। তার সুন্দর জীবনে আমার কোন জায়গা নেই। আমার অন্ধকার জীবনের কোন ছায়া আমি তার জীবনে পরতে দেই কিভাবে। একদিকে পরিবার অন্য দিকে আমার সন্তান। কাকে বাদ দিবো আমি???
অয়ন আজ অনেকদিন পর শপিং করতে গেছে। নিজের জন্য নয় রেনুর জন্য একটা বেনারসি কিনবে। লাল টুকটুকে বেনারসি। যেটা পরে রেনু অয়নের জন্য বউ সাজবে।
আমাকে সব সমস্যার সমাধান যলদি করতে হবে। অনেক গুলো জীবন গুছিয়ে দিতে হবে। আর সময় খুব কম।
আমি সেই তখন থেকে তাকে দেখছি। সে কাজ করছে আর আমি দেখছি। কেউ কোন কথা বলছি না।
অয়ন- কিছু বলবে??
আমি চুপ করে রইলাম।
সে উঠে এসে আমার পাশে বসলেন। আমি তাও তাকে দেখছি।
অয়ন- কোনো কিছু কি তোমাকে বিরক্ত করছে। কিছু বলতে চাও??
আমি মাথা ঝাকিয়ে না করলাম। মনে মনে বললাম এ কথা আপনাকে বলে আর কোন লাভ হবে না। আর আমি নিজের জন্য আপনার জীবনে কোন বাধা সৃষ্টি করতে চাই না।
অয়ন- কি হলো। বলো কি ভাবছো।
রেনু- কিছু না।
অয়ন- আমি কিছু বলেছিলাম সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছো????
আমি তারদিকে চোখ তুলে তাকালাম।
অয়ন- ভেবেছো??
রেনু- কি করতে চান আপনি???
অয়ন- যা তোমার প্রয়োজন। তুমি তোমার পরিবারের জন্য যা চাও তাই করব।
রেনু- পারবেন আপনি??
অয়ন- একবার বলেই দেখো না।
রেনু- আমি আমার পরিবারের জন্য একটা সুন্দর ঠিকানা চাই৷ যেখানে তারা নিশ্চিন্তে থাকবে। আমার বাবার ঔষধের জন্য যেনো আমার মাকে চিন্তা না করতে হয়। আমার বোনদের লেখাপড়ার জন্য যেনো কোন ল্যাপটপ বিক্রি না করা লাগে। পারবেন???
অয়ন আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন৷
অয়ন- তুমি ঘুমিয়ে পরো। আমি তোমার স্বপ্নের নগরী তৈরি করে আসছি।
বলেই সে চলে যায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সে বসে আছে। মিটমিট করে হাসছে। আমি উঠে যেতেই আমাকে একটা বক্স এগিয়ে দিলেন।
রেনু- এটা কি??
অয়ন- খুলে দেখো।
বক্সটা খুলতেই ভেতর থেকে কিছু পেপার আর চাবি বেরিয়ে এলো। আমি তার দিকে তাকালাম।
অয়ন- পড়ে দেখো।
আমি পেপার গুলো পড়তে শুরু করলাম। অয়ন আমার নামে ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই ফ্ল্যাটের পেপার আর চাবি৷
অয়ন- চাইলে আজই উঠতে পারো। আর তোমার এ্যাকাউন্টটা চেক করে নিয়ো আজ একবার।
আমি কিছুই বলতে পারছি না। মানুষটা রাতারাতি আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্ত করে দিলো।
মাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে ফ্ল্যাটটাতে উঠলাম। আমার নামে ফ্ল্যাট বলা যাবে না তাই কোম্পানির ফ্ল্যাট বললাম।
আজ সকাল থেকে তুবা আপু বার বার ফোন দিচ্ছে আমি কল রিসিভ করছি না৷ এভাবে কতোক্ষণ কল রিসিভ না করে থাকবো তাই বাধ্য হয়েই রিসিভ করলাম।
রেনু- হ্যালো আপু।
তুবা- তুই কি রে??? দু দিনের কথা বলে কোন খবরই নেই। আর কতো দেরি করবি??? আমার কথা শুন কালই এবোর্শনটা করিয়ে ফেল।
.
#চলবে….