পতিতা পর্ব-১১ | Potita -11 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

টুনি- অয়ন চৌধুরীর ভালোবাসা সোহা।

আমি অপলক তাকিয়ে আছি টুনির দিকে। টুনি উঠে গিয়ে একটা এ্যালবাম বের করে এনে আমার হাতে দিলো। আমি এ্যালবাম টা খুলতেই একটা মেয়ের ছবি দেখতে পেলাম। টুনি বলে উঠল।

টুনি- সোহা জামান। অয়ন চৌধুরীর জীবনের প্রথম প্রেম। প্রথম ভালোবাসা।

আমি একবার টুনির দিকে তাকিয়ে আবার এ্যালবামের দিকে মনোযোগ দিলাম সাথে টুনি বলতে শুরু করল।

টুনি- আমি তখন নতুন এসেছি। এতো কিছু জানি না। কে যেনো এলো বাসায় আমি দরজা খুলতেই দেখি একটা মেয়ে। নাম পরিচিয় জানতে চাইলে উল্টো আমাকে বলে আমি কে। আমি কোন মতেই তাকে ভিতরে আসতে দিবো না। সে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। স্যার এসে দেখেতো হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি তাকে জেরা করছি দেখে। স্যারকে হাসতে দেখে অনেক ঝাড়লো। আমি তখনো তাকে বাঁধা দেই তাকে উল্টো ঝেড়ে দেই বলি এই এই আপনে হেরে ঝাড়েন কে??? পরিচয় তো দেন নাই আবার চিল্লায়। এবার স্যার হাসি থামিয়ে আমাকে বলল।

অয়ন- এভাবে বলে না টুনি৷ ও অপরিচিত কেউ নয়।

টুনি- তাইলে কে পরিচয় দে না কে।

অয়ন- ও হলো আমার বউ।

টুনি- আপনের বউ?? তাইলে এই কয়দিন কই আছিলো??? বাপের বাড়ি গেছিলো??

আমার প্রশ্ন শুনে স্যার হেসেই যাচ্ছিলেন।

টুনি- হাসেন কে?

অয়ন- না বাপের বাড়ি যায় নি। ও ওখানেই থাকে কারণ আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি হবে।

টুনি- সেদিন জানতে পারলাম তারা একে অপরকে ভালোবাসে। আমি আমার চোখের সামনে তাদের ভালোবাসাটাকে বেড়ে উঠতে দেখেছি। ভালোবাসা ছাড়াও তাদের আরেকটা সম্পর্ক আছে। তারা সম্পর্কে কাজিন৷ সোহা আপু স্যারের খালাতো বোন। খুব ভালোবাসতো একে অপরকে। সবাই রাজি ছিলো তাদের সম্পর্কের জন্য। আমি একটু একটু করে সম্পর্কটাকে বড় হতে দেখেছি। স্যার অনেক কথাই বলতেন আমাকে। কোথায় ঘুড়তে গিয়েছে। কবে কোন ছবি দেখতে গিয়েছে। সবি বলতো আমাকে। এমন কি একবার সোহা আপুর পরীক্ষার জন্য প্রায় ১ মাসের উপর আপু এই বাড়িতে আসে নি। স্যারেরও যাওয়ার নিষেধ ছিলো। কিন্তু স্যার একদিন আর থাকতে না পেরে শেষেমেষ বাড়ির পাইপ বেয়ে সোহা আপুর বারান্দা দিয়ে গিয়ে দেখা করে। এটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না আজ আপনি জানলেন। সব কিছুই ভালো চলছিলো। আমার চোখের সামনেই এতো গুলো বছর কাটলো। তারপর যখন চাচাজান মানে স্যারের বাবা মারা গেলেন। ব্যবসার সমস্ত দায় দায়িত্ব স্যারের উপর এসে পরল। একা সব দিকে সামাল দেয়া লাগছিলে স্যারের। সোহা আপুকে যে সময় দিতো না তা নয়। এমন কি সোহা আপুও প্রায় সময় এ বাড়িতে এসে থাকতেন তখন। স্যার প্রায় সময়ই ব্যবসার কাজে দেশের বাহিরে যেতেন। আর ঐ সময় গুলো কখনো সোহা আপু এ বাড়ি থাকতেন আবার কখনো থাকতেন না। ধীরে ধীরে সবই স্বাভাবিক হতে থাকে। স্যারের একটা গেষ্ট হাউজ আছে। অনেক শখ করে বানিয়েছেন। ঐ গেষ্ট হাউজে স্যার আর সোহা আপু ছাড়া অন্য কারো যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। দু বছর আগে সোহা আপুর জন্মদিনের তিন দিন আগে স্যার একটা কনফারেন্সের জন্য জার্মান যায় ৭ দিন থাকা লাগবে। কিছুই করার নেই। সোহা আপু অনেক মন খারাপ করে। এই প্রথম তার জন্মদিনে স্যার থাকবেন না৷ প্রতিবছর স্যারই সব প্লেন করে পার্টি থ্রো করে। একবার তো ডেস্টিনেশন বার্থডেও সেলিব্রেট করেছিলেন মালেশিয়া গিয়ে। স্যার অনেক বুঝিয়ে সোহা আপুর রাগ ভাংগায়। আমরা কেউ জানতামই না ঐটা স্যারের প্লেন ছিলো। কারণ স্যার সেবার আরো বড় কিছু প্লেন করে রেখে ছিলো। বিয়ের জন্য প্রোপজ করবে সোহা আপুকে আর এটাই তার জন্ম দিনের সারপ্রাইজ হবে। অনেক খুশি হবে সোহা আপু এমন কিছু পেলে জন্ম দিনে। কারণ তখন তো তার রাত দিন কাটতো এটা ভেবেই কবে সে তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য বউ সাজবে। প্লেন অনুযায়ী সব হয়। স্যারের জার্মানিতে কনফারেন্স ছিলো তবে তা দুই দিনের। ইচ্ছা করে ৭ দিন বলে। সোহা আপুর জন্ম দিনের দিনই ফিরে আসেন সে। আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। স্যার সোহা আপুর বেষ্ট ফ্রেন্ড তানিয়া আপুর সাথে মিলে সব প্লেন করে। তানিয়া আপু সোহা আপুকে নিতে তার বাসায় গেলে জানতে পারে সে বাসায় নেই। স্যার তার জন্মদিনে থাকবে না বলে সে মন খারাপ করে চলে গেছে৷ স্যার জানে সোহা আপু মন খারাপ করলে গেষ্ট হাউজে যায়। তাই স্যার প্লেন অনুযায়ী সোহা আপুর জন্য রিং আর কেক নিয়ে গেষ্ট হাউজের জন্য বেরিয়ে পরে। রাত প্রায় ৩ টা উপরে বাজে। কলিং বেল বেজে উঠল। এতো রাতে কারো আসার কথা না। কারণ স্যার বাসার বাহিরে আছে আর সে তো সোহা আপুকে নিয়ে তাদের গেষ্ট হাউজে। তাহলে এসময় কে এলো৷ আমি বাড়ির দরজা খুলতেই দেখলাম স্যার। তাকে দেখে চমকে গেলাম। স্যার এসেছে এজন্য নয়। কি হাল করেছে নিজের এটা দেখে। যে মানুষটা কয়েক ঘন্টা আগে জীবনের নতুন সূচনা করার জন্য গেলো তার এই অবস্থা কেনো। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি এখন আর সোহা আপু কোথায়?? স্যার আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে রুমে চলে গেলেন। সারারাত ভাংচুর করলেন রুমের মাঝে। পাগলের মতো নিজের উপর অত্যাচার করলেন। আমরা অনেক ভয় পেয়ে যাই কি এমন হলো। সোহা আপুকে ফোন দিয়েও কোন ভাবেই পাই না। তিনদিন পর স্যারের রুমের দরজা ভেংগে তাকে বের করা হয়। মেঝেতে পরে ছিলো রক্তাক্ত অবস্থায়। ১ সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে তারপর তাকে বাসায় নিয়ে আসি। তবে আগের মতো আর কথা বলে না৷ হাসে না। মানুষটা যেনো নিজের সব হারিয়ে ফেলেছে। আমরা কোন ভাবেই জানতে পারছি না। কি হয়েছিলো সে রাতে। চাচীজান দিন রাত কান্না কাটি করে যাচ্ছেন। আর সহ্য করতে না পেরে শেষমেষ এক কাপ চা নিয়ে তার রুমে গেলাম। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন।

অয়ন- যা এখান থেকে। আমি চা খাবো না।

টুনি- চলে যাবো।

অয়ন- এখন যা।

টুনি- যাবো না

অয়ন- যাইতে বলছি টুনি।

টুনি- যাবো না বললাম তো। আজকে আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এক পাও নড়বো না আমি।

অয়ন- দেখ টুনি একদম রাগাবি না। বের হো এখন।

টুনি- যামু না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন চলে যাবো চুপচাপ।

অয়ন- টুনি

টুনি- কেন নিয়া আসছে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে। আপনি বলেন আপনাকে ভাইয়া ডাকতে আজকে ডাকতেছি বলেন না ভাইয়া কি হয়েছে???

অয়ন- টুনি যা

টুনি- না আমার ভাই নিজেকে এভাবে শেষ করে দিবে আমি তা সহ্য করতে পারবো না। বলেন না ভাইয়া কি হয়েছে?? সোহা আপু কই???

সোহা আপুর নাম শুনে সে যেনো আরো রেগে গেলেন।

অয়ন- টুনি বের হো বলছি।

টুনি- ওহ আমি তো রাস্তার মেয়ে আমাকে কেনো বলবেন। আমি তো আপনার আপন বোন না। আপনার বাড়ির আশ্রিতা। আমারই ভুল অধিকার ফলাতে এসেছিলাম।

বলেই বেরিয়ে যেতে নিলেই। স্যার ডাক দিলেন। পিছনে ঘুড়তেই দেখি স্যার ফ্লোরে বসে আছেন। আমি গিয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। স্যার আমার দিকে তাকালেন।

টুনি- কি হয়েছে ভাইয়া।

সে বলতে লাগলেন এমন কিছু শুনবো ভাবতেও পারি নি।

সেদিন যখন স্যার গেলেন সোহা আপুকে সারপ্রাইজ দিতে। তখন সে নিজেও জানতো না যে উল্টো সারপ্রাইজ তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। সোহা আপুকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য সে অনেক টা সময় গেষ্ট হাউজের বাহিরেই অপেক্ষা করেছেন। তারপর ১২ টা বাজতেই ফুল কেক আর রিং নিয়ে গেষ্ট হাউজের ভিতরে যায়। নিচে সোহা আপুকে পায় না। তাই সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে নিলেই হাসির শব্দ পায়। কথাটা শুনতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে আর ঐ মানুষটার ভেতর কেমন করে তা আমরা ভাবতেও পারবো না। কারণ হাসির শব্দ শুধু একা সোহা আপুর নয় সাথে অন্য কারো শব্দও পাওয়া যাচ্ছিলো। উপরে উঠে রুমের দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে যায় ভেতর থেকে লক করা ছিলো না৷ এমন কিছু দেখবে তা সে কখনোই আশা করে নি। তাও সোহা আপুর কাছে। সোহা আপুর সাথে অয়ন স্যারের বেষ্ট ফ্রেন মেঘ ভাইয়া। এটা দেখে যেনো তার দুনিয়াটাই ঘুড়ে যাচ্ছিলো। স্যারের পিছনে তারই বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে সোহা আপুর সম্পর্ক। তাও এমন একটা দিনে তাদের প্রিয় জায়গায় সোহা আপু অন্য একটা ছেলে তাও স্যারের বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে এমন অন্তরঙ্গ মূহুর্তে দেখবে তা কখনো ভাবতেও পারে নি। কথা গুলো বলার সময় স্যার আমার চোখের দিকে তাকাতে পারে নি৷ কতটা লজ্জা করছিলো তার তা আমি জানি। তাই আর কোন প্রশ্ন করি নি। তারপর আর কখনো এই বিষয়ে কোন কথাও বলি নি৷ তখন থেকেই মানুষটা বদলে যায়। যে মানুষটা সব সময় হাসতো তাকে কতদিন হাসতে দেখি নি। চাচীজান যেদিন মারা গেলেন। ঐ বাড়ির সবাই এসেছিলে সোহা আপুও তবে স্যার তাকে বাড়িতে ডুকতেও দেননি। চাচীজানকে দেখতে দেওয়া তো দূরের কথা। ঐ বারই শেষ দেখে ছিলাম সোহা আপুকে আর দেখি নি। শুনেছি তার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। চাচীজান মারা যাওয়ার পর স্যারটা একদম একা হয়ে গেলেন। তার আর কেউ রইল না।

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে ফেলল টুনি। কথার সাথে কত ফোঁটা চোখের পানি পরল টুনির তার হিসেব নেই। আমি টুনিকে না আর কিছু বলতে পারলাম না জিজ্ঞেস করতে পারলাম। ভেতরটা কেমন যেনো করছে আমার।

টুনি হয়ত আমার অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে আর কিছু বলল না। চলে গেলো। আমি সেই থেকে বারান্দায় এসে দাড়িয়ে আছি। মানুষটাকে এখন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমার। নিজের অজান্তেই তার জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি বেয়ে পরল আমার।

.

#চলবে……

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads