মায়াকথন পর্ব-৪ | Mayakathon -4 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

-তাহলে কেন মুনমুন নওয়াজের জন্য অপেক্ষা করলো না? কেন আমার মুনমুন মায়া হয়ে গেলো? এই মায়ার মাঝে নওয়াজের মুনমুনের অস্তিত্ব কোথায়?
নওয়াজকে দেওয়ার মতো কোন জবাব নেই মায়ার কাছে। নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে থাকে মায়া নওয়াজের দিকে। এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এখন নওয়াজের চাহনি অশান্ত, অস্থির ও অবাধ্য। নওয়াজের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ মায়ার মুখে, সে জবাব চায়।
-এতদিন পরে অতীত ঘেটে কি লাভ বলো?
-লাভ ক্ষতির হিসাব করতে আমি আসিনি মুনমুন। আমি শুধু জানতে চাই কেন আমার মুনমুন তার সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে এমন একটা জীবন যাপন করছে? কেন সে তার সাজানো গুছানো জীবন ফেলে এই নষ্ট গলির রানী হলো? আমার মুনমুনের তো স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। ডাক্তার হয়ে সে মানুষের শরীরের রোগবালাই সারিয়ে তুলবে তাহলে আজ কেন সে নিজের শরীর বিক্রি করে ফিরছে? কেন মুনমুন? বলো আমাকে।
মায়া মায়া মুখ করে তাকিয়ে আছে নওয়াজ মায়ার দিকে। এই মানুষটার বুকের আর্তনাদ ঠিক আঁচ করতে পারছে মায়া কিন্তু জীবনের এমন পর্যায় এসে তার কিছুই করার নেই। তার জীবনটা অনেক আগেই পঁচে গেছে। পঁচে গলে যাওয়া একটা উৎকৃষ্ট জীবন যাপন করছে মায়া।
-চুপ করে থেকো না মুনমুন আমি কেবল বলার জন্য বলছি না বা প্রশ্ন করার জন্য করছি না। আমি আমার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর চাই।
-অনেক রাত হয়েছে নওয়াজ এতো সময় কোথায় বলো অতীত কাঁথা খুলে বসবো। আবার সূর্য উঠলেই আমাকে চলে যেতে হবে আমার সেই নষ্ট পাড়ায়।
-আমার বোজাপড়া শেষ না করে আমি কাউকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না মুনমুন।
এবার যেন অনেক শক্ত হয়ে জেঁকে বসে নওয়াজ। এই নওয়াজের সাথে মুনমুন আগেও কখনো পারতো না এখনো পারবে না তা সে খুব করে জানে। মুনমুন তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আর নওয়াজ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাহিরে যাওয়ার। নওয়াজ খান বংশের কনিষ্ঠ পুত্র। তার বাবা মুনির খানের ইচ্ছে তার ছোট ছেলে কানাডার যে কোনো একটা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তার বাকি লেখাপড়াটা শেষ করুক। বাবার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তা পূরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো নওয়াজ। একি স্কুল কলেজের স্কুল শাখায় মুনমুন ও কলেজ শাখায় নওয়াজ পড়ালেখা করতো। স্কুল, কলেজে যাওয়া আসার দরুন বহু বার তাদের দেয়া হয়েছিল। সেই দেখা থেকেই একে অপরের মনের ভেতর একটা সুপ্ত ভালোলাগার তৈরি হলেও তারা কেউ কখনো তা একে অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারেনি। প্রকাশটা ঘটে ঠিক কোচিং করার সময়। কানাডার কলেজে এডমিশনের জন্য আইএলইটিএস সহ বিভিন্ন কোচিং ও পড়া নিয়ে ব্যস্ত নওয়াজের বিকেলের একটা কোচিংয়ের ঠিক পাশের কোচিং থেকেই একদিন ঝলমলে বিকেলে বেরিয়ে আসে মুনমুন। পরীক্ষার পরে আর কলেজ না যাওয়ার ফলে মুনমুনের সাথে দূরত্ব তৈরী হওয়া নওয়াজ যেন নতুন করে মুনমুনের সাথে সম্পর্ক তৈরীর রাস্তা খুঁজে পেলো। নওয়াজের হাতে সময়ও কম ছিল তাই তার বন্ধু রিফায়াতের সাহায্য নিয়ে একদিন সময় সুযোগ বুঝেই মুনমুনকে নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়ে দেয় নওয়াজ সেই সাথে নিজেও জেনে নেয় মুনমুনের মনের সবটা জুড়ে তারই বসবাস। তখন অবশ্য প্রেম সম্পর্কে তেমন একটা আইডিয়া নেই মুনমুনের আর নওয়াজ তো দারুণ ব্যস্ত তার বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। তখন থেকেই শুরু হয় মুনমুন আর নওয়াজের ভালোবাসাবাসি আর কাছে আসাআসির গল্পের তবে তা স্থায়িত্ব পায় না।
-প্লিজ চুপ করে থেকো না মুনমুন আন্সার মি।
অতীত ভাবনার অতলে হারিয়ে ছিল মায়া। হঠাৎ নওয়াজের ঝাঁকুনিতে আবার বাস্তবতায় ফিরে আসে সে।
-প্লিজ নওয়াজ এসব কথা বাদ দাও। এসব অতীত ঘেটে কি লাভ বলো? আজ যেমন হুটহাট আমাদের দেখা হয়েছে কাল তেমনি আবার আমরা আমাদের বাস্তবতার কাছে হারিয়ে যাবো। এই রাতটাকেও অতীত মনে করে ভুলে যেও।
-আগে রাতটাকে অতিবাহিত হতে দাও তারপর না হয় অতীত ভেবে নিবো। তুমি ভাবতেও পারবে না কীভাবে হন্য হয়ে আমি তোমাকে খুঁজেছি। হুটহাট কিছুই ঘটে না জীবনে মুনমুন।
-তুমি খুঁজেছো আমাকে!
-না খুঁজলে কি আর এমনি এমনি রাস্তায় পেয়ে গেলাম তোমাকে বলো?
-কীভাবে পেলে তুমি আমাকে?
-বলবো সব বলবো তার আগে তুমি আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও প্লিজ।
নওয়াজ মায়ার কোলের উপরে রাখা হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরে৷ নওয়াজের দৃষ্টিতে স্পষ্ট আঁকুতি। এই আকুতি ফেরাবার আর জো পাচ্ছে না মায়া। একবুক হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মায়া জিজ্ঞেস করে,
-কী জানতে চাও?
-কী হয়েছে আমার মুনমুনের সাথে? কী এমন ঘটেছে যার জন্য আমার মুনমুন আজ মায়া হয়ে গেছে?
-শুনো তাহলে, ছয় বছর আগে তুমি চলে গেলে কানাডা। আমি আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। রিফায়াত ভাই একদিন এসে তোমার কানাডার ফোন নম্বর আর তোমার মেইল নম্বর দিয়ে গেলেন আমাকে। বললেন তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। আমার নিজের মোবাইল ফোন ছিল না বলে তখন তোমার সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম ছিল মেইল। প্রতিদিন আমরা যত্ন করে একে অপরকে দু’বেলা করে মেইল করতাম।
নওয়াজ মায়াকে বাঁধা দিয়ে বলে,
-এসব আমার জানা মুনমুন।
-প্লিজ আমাকে আমার মতো বলতে দাও।
-আচ্ছা ঠিক আছে তুমি বলো।
মায়া আবার বলতে শুরু করে,
-নিয়ম করে প্রতিদিন আমরা মেইল করতাম একে অপরকে। আর সপ্তাহে একদিন বান্ধবীদের ফোন করার নাম করে কখনো বাসার ফোন, কখনো বাবার ফোন কখনো বা আম্মুর ফোন দিয়ে তোমার সাথে কথা বলতাম। আমার মাধ্যমিক পরীক্ষাটা খুব ভালো হলো, খুব ভালো। এতো ভালো রেজাল্ট করে মেডিকেল পড়ার স্বপ্নটা আরও মজবুত হয়ে গেল আমার। আমি উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুতি শুরু করবো তাই বাবা বললেন উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস শুরু হয়ে গেলে তো পড়ালেখার চাপে আর কোথাও যাওয়া হবে না তাই আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ী লোহাগড়া বেড়াতে গেলাম। তোমাকে মেইল করে জানিয়ে গেলাম সাত দিনের জন্য যাচ্ছি। তখনও জানতাম না এই বেড়ানোটাই বাবা-মার সাথে আমার শেষ বেড়ানো হবে। জানলে আমি কখনোই যেতাম না। লোহাগড়া থেকে ফিরে আসার দিন আমাদের একটা এক্সিডেন্ট হয়। যে এক্সিডেন্টে আমি বেঁচে গেলেও বাবা-মা একজনও বাঁচেননি।
এতটুকু বলেই থামে মায়া। নওয়াজ এক মুহূর্তের জন্যও মায়ার হাত ছাড়েনি।
-এই পর্যন্ত সবটাই আমি জানি মায়া। কিন্তু তারপর তো তুমি তোমার বোন ছায়া আপুর সাথে থাকতে শুরু করলে তাহলে কী এমন হলো?
এবার মুখ তুলে তাকায় মায়া নওয়াজের দিকে। ঘেন্নায় ভেতর থেকে গুলিয়ে আসতে লাগে মায়ার।
.
চলবে….

Related Posts

Leave a Comment

Direct link ads