মায়াকথন পর্ব-৬ | Mayakathon -6 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

“হোয়াট! কিন্তু কেন?”
“বলছি। আমিও তোমার মতোই অবাক হয়ে ছিলাম সেদিন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন আপু?’ আপু জবাবে বলেছিল, ‘বাচ্চা নেয়া বা ফ্যামিলি করা নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই।’
‘এটা কেমন কথা আপু?’ জানতে চাইলে সেদিন আপু বলেছিল শুধু মাত্র বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়ে এতবছর একটা মানুষ রূপী অমানুষের সাথে সংসার করে গেছে সে। বাবা অনেক শখ করে, দেখে পছন্দ করে আপুর বিয়ে দিয়েছিল। আপুর বিয়ের সময় বাবা অনেক খুশি হয়েছিল। তাই বাবার কথা ভেবে এসব কথা আপু কোনোদিন আমাদের বলেনি। মুখ বুজে সব সহ্য করে একটা জানোয়ারের সাথে সংসার করে গেছে।”
“এমন একটা অন্যায়কে ছায়া আপু কেন প্রশ্রয় দিয়েছিল?” অবাক হয়ে জানতে চায় নওয়াজ। জবাবে মায়া বলে, “আমি আপুর কাছে একথা জানতে চাইলে বাবার কথা বলেছিল সে। আপু আরও বলেছিল, ‘জানিস মুনমুন শুধু বাবা কষ্ট পাবে বলে কোনোদিন তোদের বলিনি আমি সুখে নেই। সবসময় দেখিয়ে গেছি আমি সুখে আছি। মেকি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি ঠোঁটের কোণে। নাহলে ভাব তো কোন মা নিজের গর্ভে আসা দুই দুইটা সন্তানকে নিজের হাতে শেষ করে দিবে? কোনো মায়ের পক্ষে কী এমন করা সম্ভব? তবু আমি করেছি, করতে বাধ্য হয়েছি। না করলে তোর দুলাভাই আমাকে হুমকি দিয়েছিল ছেড়ে দেয়ার। শুধুমাত্র সে যেন আমাকে ছেড়ে না দেয় সেজন্যই তার এই অন্যায় আবদার আমি মেনে নিয়েছিলাম। তবে এক হিসেবে ভালোই হয়েছে জানিস। এমন জানোয়ারের ঘরের আরেকটা জানোয়ার জন্ম দেয়ার থেকে আমি আজীবন সন্তানহীন থাকবো সেটা অনেক ভালো। ঐ মানুষটার জন্য টাকাই সব রে। টাকার জন্য সে সব করতে পারে। হয়ত জানতে পারলে আমার এই সন্তানটাকেও মেরে ফেলবে সে।’ আপুর কথা শুনে আঁতকে উঠেছিলাম আমি। আঁতকে উঠে বলেছিলাম, ‘কী যা তা বলছো?’
‘ঠিকই বলছি।’
‘তাহলে কী এজন্যই দুলাভাই তোমার গায়ে হাত তুলেছে?’
আপুর চোখের পানি মুছে বলল, ‘না।’
‘তাহলে!’
‘ঐ জানোয়ারটা এখনো জানে না আমি আবার সন্তান সম্ভবা। এবারের ঘটনা অন্য জায়গায়।”
‘কী হয়েছে এবার?’
‘তোর মনে আছে তুই আমাদের বাসায় থাকতে ওর এক ক্লাইন্ট বাসায় এসেছিল।’
‘হ্যাঁ মনে আছে।’
‘সেই লোকটা ওকে অনেক বড় একটা প্রজেক্ট অফার করেছে কিন্তু বিনিময়ে তার কিছু চাই।’
‘কী!’ আঁতংকে মুনমুনের বুকের ভেতর ডিপডিপ করছে। ছায়া বলল, ‘লোকটা সেদিন তোকে দেখেছিল। সে বলেছে তোকে তার একরাতের জন্য চাই। তাহলেই সে তোর দুলাভাইকে পঞ্চাশ কোটি টাকার একটা কাজ দিবে।’
“হোয়াট!” চিৎকার করে ওঠে নওয়াজ। মায়া খুব শান্ত ভঙ্গিতে নওয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সামনে শুনবে না এখানেই থেমে যাবো?”
মায়াকে কোনো জবাব না দিয়ে উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে এক নিঃশ্বাসে টান দিয়ে বোতলের অনেকটা পানি শেষ করে দেয় নওয়াজ। তারপর আবার ফিরে এসে পূর্বের ন্যায় মায়ার হাত ধরে তার সামনে বসে বলে, “এবার বলো।”
মৃদু হেসে মায়া বলল, “এতটুকুতেই গলা শুকিয়ে গেল তোমার? সত্যি সামনে শুনতে পারবে তো?”
একবার ঢোক গিলে নওয়াজ বলল, “তুমি বলো আমি শুনছি।”
মায়া আবার বলতে লাগলো, “আপুর কথা শুনে যেন আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। আপু কী করবে কিছুই তার মাথায় আসছে না। তবু সে আমাকে আশ্বস্ত করলো যেভাবেই হোক সে দুলাভাইকে আটকাবে। ঐ কথা শুনার পরে বুঝতে পারলাম হঠাৎ দুলাভাই কেন আমার বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। মানুষটার প্রতি আমার অনেক সম্মান ছিল যা ঐ এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। প্রচন্ড ঘৃণায় বমি পাচ্ছিলো আমার এটা ভাবতে সে আমার দুলাভাই, বোনের হাসবেন্ড। এরপরের দিনগুলোতে আমি চেষ্টা করেছি তাকে এড়িয়ে চলার। দুলাভাই যতক্ষণ বাসায় থাকতেন আমি নিজের ঘর থেকে বের হতাম না। নিজেকে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতাম। ঐ ঘটনার সাতদিন পরের কথা। দুলাভাই আপুকে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে গেলেন। হঠাৎ তাদের ফিরে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না। আপুর কাছে আর জানাও হয়নি সে বাচ্চাটার কথা দুলাভাইকে বলেছিল কিনা। ভেবেছিলাম আপাতত থাক পরে কোনো একসময় ফোন করে জেনে নেয়া যাবে। ওরা চলে যাওয়ায় কিছুটা হাফ ছেড়ে বেঁচে ছিলাম আমি। কিন্তু বিপদ যে তখনও আমার মাথার উপরেই তান্ডব নাচছিল তা বুঝতে পারি সেই রাতেই। হঠাৎ রাত প্রায় দশটার উপরে বাজে এমন সময় বাসার কলিংবেল বেজে ওঠে। এই সময় কারো আসার কথা নয়। আমাদের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই। গেইট না খোলায় বারবার কলিংবেল চেপেই যাচ্ছে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই দরজা খুললাম আমি। দরজা খুলেই সাপ দেখার মতো শক্ত হয়ে গেলাম। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ঐদিনের ঐ লোকটা যাকে দেখে আমার চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাই আমার দুলাভাইর ক্লাইন্ট যার কথা আপু আমাকে বলেছিল। লোকটাকে দেখে একদিকে যেমন আমার খুব ঘৃণা পাচ্ছিলো অন্যদিকে ভয়ও করছিল। আমি বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি জোরপূর্বক লোকটা বাসায় ঢুকে যায়। সে এখানে কী চায় জানতে চাইলে অসভ্য জানোয়ারটা বলে দুলাভাই নাকি তাকে এই ঠিকানা দিয়েছে। আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না ঘটনা কী ঘটছে আর সামনে কী ঘটতে পারে।”
এতটুকু বলে নওয়াজের হাতটা এবার মায়া নিজ থেকে শক্ত করে ধরে। নওয়াজের দৃষ্টিতে স্পষ্ট আতংক। সে বারে বারে ঢোক গিলছে। হয়ত তার গোলা শুকিয়ে আসছে। শুকনো গলায় নওয়াজ জিজ্ঞেস করে, “তারপর কী হলো মুনমুন?”
“তারপর! আমার সর্বনাশ হলো। সেদিন নিজের শেষ রক্ষা করতে পারিনি আমি। এই রকম দানব একটা জানোয়ারের সাথে আমার মতো একটা বাচ্চা মেয়ে পারে বলো? সারাটা রাত…সারারাত জানোয়ারটা আমায় ভোগ করেছে। আমি নিজেকে বাঁচাতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেছি তবু পারিনি জানো।”
কথায় এই পর্যায় মায়ার দুই চোখ উপচে পানি বেরিয়ে এলো। নিজের প্রেমিকের কাছে নিজের সর্বনাশের কথা কোন প্রেমিকা বলতে পারে! তবু মায়াকে বলতে হচ্ছে। নওয়াজের চোখ জোড়া লাল হয়ে গেছে। লাল চোখ জোড়া ছলছল করছে পানিতে। নওয়াজ আর নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। মায়া নিজেই বলল, “সকাল বেলা দুঃখে, কষ্টে, যন্ত্রণায় কী করবো কিছুই আমার মাথায় আসছিল না। তখনো জানোয়ারটা আমার বাসায়, আমার বিছানায় পরে পরে ঘুমাচ্ছিল। হুট করে আমার কী হলো আমি জানি না। ফ্লোর থেকে উঠে রান্না ঘরে গিয়ে একটা ছুড়ি এনে ঘুমন্ত অবস্থায় জানোয়ারটার পেটে বসিয়ে দিলাম। ঘুমের মধ্যেই জানোয়ারটা একেবারের জন্য ঘুমিয়ে পরলো। একটু ছটফটও করলো না তার আগেই শেষ হয়ে গেল। জানোয়ারটাকে মেরেও আমার ভেতরের আগুনটা নিভছিল না। কী করবো কিছুই মাথায় আসছিল না আমার। ঐ ছুরিটাই ভালো মতো পানি দিয়ে ধুয়ে ব্যাগে ভরে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম আমি। সোজা চলে গেলাম আমার বোনের বাসায়। সকাল সকাল আপু আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। এতো সকালে আমি ওখানে কী করছি জানতে চাইলে তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু দুলাভাই কোথায়?’ সে তার ঘরেই ছিল। আমি সরাসরি সেখানে চলে গেলাম। সকাল সকাল আমাকে দেখে কিছুক্ষণ ভূত দেখার মতো তাকিয়ে রইলেন দুলাভাই। আমি এখানে কী করছি জানতে চাইলে শুধু জিজ্ঞেস করলাম সে কেন আমার এতো বড় একটা সর্বনাশ করলেন। জবাবে জানোয়ারটা বলল, ‘দেখো মুনমুন আজকাল এসব কোনো ব্যাপারই নয়। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডদের মাঝে এসব অহরহ হয়ে থাকে। তুমিও এমন কিছু ভেবে ভুলে যাও। প্রয়োজনে আমি যে কাজটা পাচ্ছি সেখান থেকে কিছু টাকা তোমাকেও দিয়ে দিবো। বলো কত টাকা চাই তোমার?’ জানোয়ারটা আমার ইজ্জতের দাম জানতে চাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে সে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তার কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি আমি। পেছন থেকে সে বুঝে উঠার আগেই ব্যাগে রাখা ছুরিটা বের করে তার পিঠ বরাবর বসিয়ে দিলাম। একবার নয়। ছুরিটা বের করে আবার বসিয়ে দিলাম। তাল সামলাতে না পেরে দুলাভাই মাটিতে পরে যায়। আমি তার পাশেই নিচু হয়ে বসে আরও কয়েকবার পেট বরাবর ছুরি চালালাম। ততক্ষণে আপু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিছুই বলতে পারেনি আপু। এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে বলল, ‘তুই চলে যা। বাকিটা আমি দেখে নিবো।’ আমি আর অপেক্ষা করলাম না। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে পরলাম। বাঁধা দিয়ে আপু আবার বলল, ‘তোর হাতে রক্ত যাওয়ার আগে হাত মুখটা ধুয়ে যা।’ আমি হতে লেগে থাকা রক্ত, মুখে লাগা রক্তের ছিটা পানি দিয়ে মুছে আপুর বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম। কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। আমার পেছনে আপু কী করবে বা তার সাথে কী হবে তাও জানি না আমি। এরপর কী হবে সব অজানা আমার।
সারাদিন পথে পথে হেঁটেছি আমি। নিজের চেনা, জানা শহরটাকে বড্ড অচেনা, অজানা মনে হয়েছিল সেদিন আমার। পথে কত জানোয়ারের সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন। যেদিকে তাকাই দেখি সব ওত পেতে আছে থাবা দেয়ার জন্য। হাঁটতে হাঁটতেই ইলিশ রোড চলে গিয়েছিলাম। সেখানেও অনেকে পথে আমাকে আজেবাজে ইশারা করেছে। কেউ কেউ আমার দাম জানতে চেয়েছে। শেষমেষ নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার পক্ষে আর দশজনের মতো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এই দুনিয়ায় বাঁচতে গেলে দুনিয়াটাকে পায়ের তলায় পিষে বাঁচতে হবে নাহলে দুনিয়া আমাকে পিষে ফেলবে। খুঁজতে খুঁজতে ঐ এলাকার অন্ধকার জগতে গিয়ে হাজির হলাম আমি। সবাই হা করে দেখছিল আমাকে। যেই দেখে তারই জিহ্বে জল চলে আসছিল আমাকে দেখে। আমি গিয়ে ঐ পাড়ার মহাজনের সামনে উপস্থিত হলাম। আমাকে দেখে মহিলা ভরকে গিয়েছিল। আমি সরাসরিই তাকে বললাম, “একটা সওদা করতে চাই।”
সে জানতে চাইলো কিসের সওদা। বললাম, “আমি নিজেকে বেঁচতে চাই তুমি কিনবে?” আমার কথা হয়তে মহিলার প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পরে যখন বুঝলো আমি সত্যি বলছি তখন আমার সব কথা শুনে অতি আবেগে মহিলা বলল, ‘তুই কোনোদিন চলে যেতে চাইলে আমি তোকে মুক্ত করে দিবো।’ সেদিন তার কথায় আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, ‘চিন্তা নেই আমি কোনোদিন যাবো না। আমার যাওয়ার কোনো জায়গায় নেই।’ সেদিন থেকেই আমি মুনমুন থেকে হয়ে গেলাম মায়া। জমিলা খালার বাগানের সব চাইতে দামী ফুল। যে আসে তার শুধু মায়াকেই চাই। মায়া ছাড়া কারো চলেই না।
.
চলবে…

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads