মায়াকথন পর্ব-৩ | Mayakathon -3 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

মায়া যখন বেরিয়ে ছিল তখন থেকেই তাকে ফলো করছে লোকটা। এতটা সময় সে মায়ার পেছন পেছনই ছিল, সামনে আসেনি। হয়তো সাহস হয়নি তার মায়ার সামনে আসার, আর নয়তো সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।

গাড়িতে আর একটা কথাও হয়নি মায়ার লোকটার সাথে। না লোকটা কিছু জানতে চেয়েছে আর না মায়া কোনো কথা বলেছে। নিঃশ্বাসের শব্দ বিহীন আর একটা শব্দও মায়ার শ্রবন উপলব্ধি হয়নি।

গাড়িটা একটা বাড়ির গেটের ভেতর এসে থামতেই মায়া কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটা নিজেই বলে,
-আমার বাড়ি, ভেতরে চলো।
মায়া কোনো কথা বলে না নিঃশব্দে হেটে চলে যায় লোকটার পেছন পেছন। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে হা করে তাকিয়ে থাকে মায়া। ডুপ্লেক্স কমপ্লেক্সের একটা বাড়ি। সাইজে বিশাল নয় তবু যথেষ্ট আকর্ষণীয়।
বাড়িতে ঢুকেই লোকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবে বলে,
-আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।
ফ্রেস হওয়ার জন্য লোকটা উপরে চলে যেতেই মায়া হা করে ঘুরে ঘুরে চারিদিকে দেখতে লাগে। মস্ত বড় একটা ড্রইং রুম যার মাঝে বিশাল করে সাজানো গুছানো সোফা পাতা। বিশাল দেয়াল জুড়ে সম্ভাব্য বায়ান্ন ইঞ্চি সাইজের একটা এলইডি টেলিভিশন ঝুলছে। মায়া এর আগে এমন ঝুলন্ত টেলিভিশন কেবল টেলিভিশনেই দেখেছে। সে পতিতালয়ে থাকলেও তার ঘরেও একটা ছোট সাইজের টেলিভিশন আছে। অবসরে সময় কাটানোর জন্য কিনেছিল সে যদিও টেলিভিশন থাকলেও অবসরটা আর তার হয়ে উঠে না ঠিক।
ড্রইং রুমের অন্যপাশে কিচেন সাথে লাগোয়া ডাইনিং আর অন্য পাশে একটা গেস্ট রুম ও একটা সার্ভেন্ট রুম। ভেতরের দিকে হালকা বাকা হয়ে একটা সিড়ি উপরে উঠে গেছে। নিচ থেকেই দেখা যায় উপরে দু’পাশে দুইটা বেড রুম ও মাঝে অনেকটা জায়গা খালি সেখানেও বসার ব্যবস্থা করা আছে। অদ্ভুত সুন্দর বাড়িটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মায়া। এমন ঝাঁক জমক না হলেও এক সময় একটা ভালোবাড়িতেই থাকতো সে নিজের পরিবারের সাথে। নিজেদের বাড়ি না থাকলেও একটা তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট ছিল তাদের। অনেক সুখের ছিল দিনগুলো মায়ার জন্য। জীবনটা তখন অনেক আনন্দের ছিল তার জন্য।
-দাঁড়িয়ে আছো কেন?
হঠাৎ লোকটার কথায় ভাবনাচ্ছেদ হয় মায়ার। সিঁড়ির দিকে তাকালেই দেখে লোকটা নেমে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটা হয়তো মাত্র গোসল করেছে তাকে দেখতে এখন আরো বেশি মোহময়ী লাগছে। মায়া চোখ ফেরাতে পারছে না। পরনে তার গিয়া রঙের ডিলেডালা প্যান্ট ও পাতলা ছোট ফতুয়া। গোসলের পরপর মানুষের চোখ-মুখের সিগ্ধ ভাব বেড়ে যায়। এই মানুষটার সিগ্ধতা মনে হয় কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গেছে। মায়া অনুভব করতে পারছে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে।
লোকটা মায়ার কাছাকাছি এসে তার হাতে একটা টাওয়াল, একটা ফতুয়া ও একটা ট্রাউজার প্যান্ট ধরিয়ে দিয়ে হাত উঁচু করে নিচতলার একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলে,
-এই কাপড় গুলো আমার ছোট হয় কিন্তু তোমার ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ঐটা গেস্ট রুম ভেতরে বাথরুম আছে তুমি ফ্রেস হয়ে নাও। চাইলে শাওয়ার নিয়ে নিতে পারো, তোমার ভালো লাগবে।
মায়া না করতে চাইছিল কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছে না সে। লোকটার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে চুপচাপ রুম ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় সে।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ভিজেছে সে। ঠান্ডা পানিটা যেন মায়ার ভেতরটা পর্যন্ত ঠান্ডা করে দিচ্ছে। এতো অস্থির কেন লাগছে মায়ার সে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন কোনো দিনের আশা সে কখনোই করেনি। তাহলে এমন একটা দিনের মুখোমুখি তাকে কেন হতে হলো?

বেশ লম্বা সময় নিয়ে শাওয়ার সেরে লোকটার দেয়া ফতুয়া আর ট্রাউজার পরে বেরিয়ে আসে মায়া। মাথার চুল অনেক ঘন হওয়ায় ভালো করে মুছবার পরেও ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে মায়া কোমড় লম্বা ঘন চুল বেয়ে।
গেস্ট রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই উল্টো দিক হয়ে সোফায় বসে থাকা লোকটা পেছন ঘুরে মায়াকে দেখে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। মায়া বাধ্য মেয়ের মতো নিঃশব্দ পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সোফায় তার পাশের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে লোকটা বলে,
-বসো।
মায়া বসতেই লোকটা সামনের টি টেবিলে রাখা চায়ের কাপ ঠিক কাপ বলা যায় না সাইজটা মগের মতো। যারা পরিমাণে বেশি চা খেতে মানে পান করতে পছন্দ করে তারা সাধারণত কাপ ব্যবহার না করে চা মগে পান করে থাকে। এই মানুষটারও চায়ের প্রতি প্রবল নেশা। চায়ের মগ দেখিয়ে বলে,
-তোমার চা চলবে কিনা জানি না। আমার রাতে অন্তত একবার না হলেই নয় তাই তোমার জন্যও করে ফেললাম। এখনো ঠান্ডা হয়নি আর ভয় নেই আমি এতে কিছু মিশাইনি।
বৃথা হাসার চেষ্টা করে মায়া। এতে বিশেষ লাভ হয় না, হাসি তার আসে না।

সামনের দেয়াল জুড়ে থাকা বিশাল সাইজের টেলিভিশনে একটা সিনেমা চলছে। ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও মায়া সিনেমা দেখছে কিন্তু তার পাশে বসে থাকা লোকটা কেবল মায়াকেই দেখছে। মায়া লোকটার থেকে একজন মানুষ বসতে পারার চাইতেও বেশি সমপরিমাণ জায়গা গ্যাপ রেখে বসেছে। তাদের মাঝে পাতলা গড়নের দু’জন আরামছে বসে যেতে পারবে এতটা দূরত্ব রয়েছে। লোকটার দিকে না তাকালেও মায়া বুঝতে পারছে মানুষটার দৃষ্টি তাতেই সীমাবদ্ধ। সোফায় ভর করে গালে হাত দিয়ে বাকা হয়ে বসে লোকটা মায়াকে দেখতেই ব্যস্ত।
বেশ লম্বা সময় বসে আছে তারা পাশাপশি তবু কারো মুখে কোনো কথা নেই। মায়ার বুকের ভেতর ডিপ ডিপ করছে। এতো অস্থিরতা, এতো অসহ্যকর অনুভূতি কখনো অনুভব করেনি মায়া। কেউ হাজারটা গালি দিয়েও মায়ার মুখ বন্ধ করতে পারেনি কখনো। কিন্তু এই মানুষটা সামনে আসতেই চুপসে গেছে মায়া। পানি বিহীন চুপসে যাওয়া গাছের মতো।
লোকটার দৃষ্টি শান্ত। খুব শান্ত ও রিলাক্স ভঙ্গিতে বসেই তাকিয়ে আছে সে মায়ার দিকে। নিজের মন মতো সময় নিয়ে মায়াকে চোখে হারিয়ে লোকটা বলে,
-কেমন আছো মুনমুন?
আচমকা লোকটার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে টেলিভিশন রেখে তার দিকে তাকায় মায়া। মায়া চেষ্টা করছে তার চোখে-মুখে যেন তার অবাক হওয়াটা প্রকাশ না পায়। সব সময় তো আর মানুষের সব চেষ্টা সফল হয় না৷ তাই মায়াকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা আবার জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছো মুনমুন?
নির্লিপ্ত কন্ঠে মায়া বলে,
-ভালো আছি।
-সত্যি ভালো আছো!
লোকটার প্রতিটা প্রশ্নে মায়ার নির্লিপ্ততা বেড়েই চলেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তার বুকের ভেতরের ডিপ ডিপ কম্পন টা।
-হ্যাঁ সত্যিই ভালো আছি।
-বেঁচে থাকাকেই কী ভালো থাকা বলে মুনমুন?
এবারে একদম চুপ মেরে যায় মায়া। লোকটার কথার জবাব দেয়ার মতো সাহস তার হচ্ছে না। লোকটা তার প্রশ্ন চালিয়ে যায়।
-আমাকে ছাড়া দিব্য বেঁচে আছো তাই না? কীভাবে বেঁচে আছো?
নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে লোকটা খানিক থেমে আবার জিজ্ঞেস করে,
-আমাকে চিনতে পারছো না মুনমুন?
এবারও চুপ মায়া।
লোকটা এগিয়ে এসে মায়ার হাটুর কাছে বসে কোলের উপরে রাখা তার হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখ তুলে মায়ার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলে,
-চিনতে পারছো না আমাকে মুনমুন?
এবারও মায়াকে চুপ করে থাকতে দেখে এক হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে পাশে থাকা খালি চায়ের মগগুলো ভেঙে ফেলে চিৎকার করে উঠে লোকটা বলে,
-সত্যি চিনতে পারছো না তুমি আমাকে?
আচমকা লোকটার চিৎকারে অস্পষ্ট কন্ঠে মায়া বলে,
-কেমন আছো নওয়াজ?
মানুষটাকে না চিনে থাকার প্রাণপণ অভিনয় করেছে এতক্ষণ মায়া কিন্তু শেষকালে এসে আর শেষ রক্ষা হলো না তার।
-মনে আছে তোমার, তোমার নওয়াজের কথা?
-মুনমুন কী তার নওয়াজকে ভুলতে পারে?
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নওয়াজ বলে,
-মুনমুন নওয়াজকে ভুলতে পারে না তবে ছেড়ে দিতে পারে।
-ভুল।
-তাহলে কোনটা ঠিক তুমি বলে দাও।
-মুনমুন কখনোই তার নওয়াজকে ছাড়েনি আর না ভুলেছে।
-তাহলে কেন মুনমুন নওয়াজের জন্য অপেক্ষা করলো না? কেন আমার মুনমুন মায়া হয়ে গেলো? এই মায়ার মাঝে নওয়াজের মুনমুনের অস্তিত্ব কোথায়?
নওয়াজকে দেওয়ার মতো কোনো জবাব নেই মায়ার কাছে। নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে থাকে মায়া নওয়াজের দিকে। এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এখন নওয়াজের চাহনি অশান্ত, অস্থির ও অবাধ্য। নওয়াজের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ মায়ার মুখে, সে জবাব চায়।
.
চলবে…

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads