সেই রাতে শুধু আমার সম্মানই বাঁচান নি আমাকে দিয়েছেন নতুন একটা জীবন।
টুনি- সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন আমাকে এই বাড়িতে৷ এই বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গেলাম। সেদিনের পর থেকে আজ ৮ বছর ধরে মার বুকে যাই না৷ কতশত রাত কাটলো আমার মাকে ছাড়া। মায়ের বুক ছাড়া। মায়ের কোল ছাড়া। আমার জীবনের ৮ টা বছর মাকে ছাড়াই কাটলো। মার কোন ছবিও নেই আমার কাছে তবু আজো মার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাই আমি। সেদিন যখন প্রথম আপনাকে দেখলাম আমি ৮ বছর পর আমার মাকে দেখলাম সেটা স্বপ্নে নয় বাস্তবতায় আপনার মাঝে। এই হলো আমার মায়ের গল্প।
আমি মুগ্ধ হয়ে টুনির কথা শুনছিলাম। টুনির প্রতিটা কষ্টের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। আজ নিজের কষ্টগুলোর বাহিরে কারো কষ্টগুলোকে এতোটা কাছ থেকে অনুভব করলাম।
এখন মেয়েটা অনেকটাই শান্ত হয়েছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে টুনি একটা হাসি দিলো একটা প্রশান্তির হাসি। মনে হয় এতো দিনের সব জমানো কথা গুলো বলতে পেরে মেয়েটা নিজেকে হালকা অনুভব করছে। কথায় কথায় যে কখন এতোটা সময় পার হয়ে গেছে দুজনের একজনও খেয়াল করি নি৷ টুনি উঠে যেতে নিলেই আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম।
রেনু- টুনি…
টুনি পিছন ফিরে তাকালো।
টুনি- জ্বি।
রেনু- মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না???
টুনি দ্রুত গতিতে ঠিক একদম আমার কাছে এসে বসে বলল।
টুনি- খুব করে।
কি মায়া মেয়েটার কথায়।
রেনু- যাবে মায়ের কাছে???
টুনি- আমার মায়ের কাছে????
রেনু- হুম। যাবে???
টুনি- মার কাছে যাবো???
রেনু- হ্যাঁ, আমি নিয়ে যাবো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে যাবে তুমি???
টুনি আর কথা বলতে পারল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউমাউ করে কান্না করতে থাকলো। আমি ওকে বাঁধা দিলাম না কারণ আমি জানি যখন বুকের ভেতরের কষ্টটা বেশি থাকে তখন একমাত্র কান্নাই মানুষকে হালকা করতে পারে। আর এই মেয়েটা তো ৮ টা বছর বুকের ভিতরে কষ্টগুলোকে লালন করেছে। বেশ কিছুটা সময় পর টুনি নিজেই থামলো।
টুনি- অনেক সময় হয়ে গেছে আপনি ঘুমিয়ে পরেন আমি যাই।
আমি টুনিকে বাঁধা দিয়ে বললা।
রেনু- অনেকদিন তো মার সাথে ঘুমাও না। আজ না হয় এই মায়ের সাথে ঘুমাও।
টুনি অবাক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেনো অনেক কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না৷
টুনি ঘুমিয়ে আছে। আমার আজ আর ঘুম আসবে না। হয়ত টুনির কষ্ট গুলো আবার আমাকে নাড়া দিয়েছে৷ আজকে নিজের জন্য নয় ঐ মেয়েটার জন্য বুকটা হা হা কার করছে আমার। ঐ টুকু একটা মেয়ে কিভাবে থাকলো মাকে ছাড়া৷ আমি তো এখনো মাকে ছাড়া এক বেলা থাকার কথা ভাবতে পারি না। আর এই টুকু মেয়ে জীবনের সব চাইতে প্রয়োজনীয় সময়ে মাকে পায় নি।
টুনি ঘুমিয়ে পরার পরেই উঠে বারান্দায় এসে দাড়াই আমি। মনে মনে মানুষটার জন্য অন্যরকম এক অজানা অনুভূতি অনুভব করতে লাগলাম। জানি না কিসের অনুভূতি তবে খুব করে অনুভব করছি। সেদিন রাতে টুনি কে বাঁচানো। ঐরাতে আমাকে অন্য কারো কাছে যেতে না দেয়া। কি যেনো টানছে আমাকে তার দিকে। তবু কিছু প্রশ্ন খুব তাড়া করছে আমাকে। ঐ পাষোন্ড লোকটার মাঝেও একজন ভালো মানুষ বিরাজ করে। তাহলে সে কেনো কখনো টুনিকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যায় নি। এমন নানারকম প্রশ্ন মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে কিন্তু কোন জবাব খুজে পাচ্ছি না। অনেকগুলো কথা ভাবতে ভাবতেই রাত পার করে ফেললাম। আজ আবার ভোর হওয়া দেখলাম। আমার শখের ভোর হওয়া। রাত থেকে হুট করেই যখন চারিদিকে আলো ছড়ায় তা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আজ আবার ভোর দেখলাম।
বাসায় যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। প্রশ্নগুলোও তাড়া করছে তাই থাকতে না পেরে টুনিকেই আবার জিজ্ঞেস করে বসলাম।
রেনু- একটা কথা বলি???
টুনি- একটা কেনো হাজারটা বলেন।
রেনু- তোমার স্যার তোমাকে কখনো নিয়ে যেতে চায় নি তোমার মায়ের কাছে।
টুনি আমার কথা শুনে হেসে দিলো।
রেনু- হাসছো যে???
টুনি- কত বার বলেছে। তবে আমার সাহস হয় নি সব বলতে। তাই কখনো বলাও হয় নি আর মায়ের কাছে যাও হয় নি।
রেনু- আমি আজ আসি তাহলে।
টুনি- বলছি কি স্যার নেই এ সময় যাওয়া টা কি ঠিক হবে??? যাদি জানতে পেরে রাগ করেন??
রেনু- তাকে বলো আমি তার সাথে কথা বলবো।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলে এলাম। সকালে আমাকে দেখলেই মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠে। আজ এসে বাবাকে জাগ্রত পেলাম। অনেকদিন পর বাবার পাশে বসে সকালের চা খেলাম। জানি না হয়ত দিনের শুরু টা ভালো হলো।
রেনু- মা আমি একটু শুয়ে পরলাম। ক্লান্ত লাগছে আমার।
মা- সারারাত জেগেছিস ক্লান্ততো তো লাগবেই৷ তুই ঘুমিয়ে নে।
আমি বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাই না। তাই কাথ হয়েই কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরলাম। চোখটা লেগে আসছে তখনি ফোন টা বেজে উঠল। আমার একদম ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ফোনটা ধরলাম। তবে চোখ খুলি নি। তাই নাম্বারটাও দেখি নি। কন্ঠ শুনলেই বুঝতে পারবো কে।
রেনু- হ্যালো
– রেনু, আমি অয়ন, অয়ন চৌধুরী বলছি।
রেনু- আপনি????
আমার চোখ গুলো খুলে গেলো। নিমিষেই আমার চোখের ঘুম কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। আমি ফোনটা দেখলাম একটা বিদেশী নাম্বার। আর উনিও বিজনেসের কাজে দেশের বাহিরে আছেন।
অয়ন- হ্যালো রেনু শুনছো??
আমি চুপ করে রইলাম।
অয়ন- রেনু
উনি এমন ভাবে রেনু বলে ডাকলেন যেনো কত চেনা সে ডাক। কত প্রিয় তার ডাকের সুর। তার রেনু ডাকটা খুব ভালো লাগছে শুনতে। ইচ্ছে করছে আমি চুপ করেই থাকি সে রেনু রেনু বলে ডাকতেই থাকুক আর আমি শুনতেই থাকি।
অয়ন- রেনু কথা বলবে না৷
রেনু- জ্বি
অয়ন- কেমন আছো??
রেনু- ভালো। আপনি কেমন আছেন???
এই প্রথম আমি তাকে কোন প্রশ্ন করলাম। তার সাথে কথা বললাম। তার সাথে তো সেভাবে কথা বলার কোন প্রয়োজন হয় নি আমার।
অয়ন- আমিও ভালো আছি৷
রেনু- হুম
অয়ন- রেনু
রেনু- জ্বি
অয়ন- টুনি বলল তুমি কিছু বলতে চাও। কোন সমস্যা হয়েছে কি??
রেনু- টুনির সাথে কখন কথা হয়েছে???
অয়ন- মাত্রই শুধু বলল তুমি কিছু বলতে চাও৷
রেনু- আমি কিছু বলতে চাই শুনেই সাথে সাথে ফোন দিয়ে দিলেন???
অয়ন- হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাছাড়া তো রেনু কথা বলে না৷
আমার কথা না বলাটাও সে লক্ষ করেছে। এতোটা কাছ থেকে লক্ষ করেছে লোকটা আমাকে অথচ আমি বলতেও পারি না। আমি কিছু বলবো শুনেই ব্যাকুল হয়ে গেছেন। তার কন্ঠে আমি স্পষ্ট ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারছি। কেনো এই ব্যাকুলতা তার???
অয়ন- বলো না কি বলবে।
রেনু- আমি টুনিকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাই৷ তাই আপনার অনুমতি চাই। টুনিকে ওর মার বুক ফিরিয়ে দিতে চাই৷
অয়ন- কবে যাবে???
রেনু- কালই।
অয়ন- আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷ আর কিছু??
রেনু- নাহ
দুজনেই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলাম। তারপর সেই বলল।
অয়ন- রেনু
রেনু- জ্বি
অয়ন- যদি সম্ভব হয় টুনির মাকে সাথে করে নিয়ে এসো। টুনিকে ছাড়া আমার বাড়িটা মরুভূমি হয়ে যাবে।
রেনু- নিয়ে আসবো।
অয়ন- রাখছি তাহলে।
রেনু- জ্বি রাখুন।
অয়ন- রেনু
রেনু- জ্বি
অয়ন- সত্যি ভালো আছো???
রেনু- হুম সত্যি ভালো আছি।
অয়ন- রাখছি।
এবার আর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে ফোনটা রেখে দিলো। আমি কিছুক্ষণ নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাম্বারটা একটা অদ্ভুত নামে সেভ করে ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে পরলাম আবার৷ অদ্ভুত নাম রহস্য কারণ মানুষটা আমার কাছে একটা রহস্য আমি তাকে বুঝেই উঠতে পারছি না।
চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পেলাম। “রেনু আমি অয়ন, অয়ন চৌধুরী বলছি।”
” সত্যি ভালো আছো”
“রেনু”
“রেনু”
বারবার আমি তার ঐ রেনু ডাকটায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম। তার প্রতিটা ডাক প্রতিটা কথা যেনো বলছিলো সে আমার কতো দিনের চেনা। কত আপন মানুষ। যেনো মানুষটা আমার আত্মার সাথে জড়িয়ে আছে।
.
#চলবে……..