সেদিন থেকেই আমি মুনমুন থেকে হয়ে গেলাম মায়া। জমিলা খালার বাগানের সব চাইতে দামী ফুল। যে আসে তার শুধু মায়াকেই চাই। মায়া ছাড়া কারো চলেই না।
এই পর্যন্ত বলে থামে মায়া। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উন্মুক্ত করে দিয়ে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করে। মায়ার চোখ উপচে পরা পানি তার গালেই শুকিয়ে গেছে অনেক আগে। তারপর আর চোখে পানি আসেনি তার। এমনিও সেই ঘটনার পর কোনোদিন মায়ার চোখে পানি আসেনি। আজ নওয়াজকে দেখে, প্রিয় মানুষটার কাছে নিজের ভয়ংকর অতীত বর্ননা করতে গিয়ে খৈ হারিয়ে ফেলেছিল সে। তাই চোখ উপচে কিছুটা পানি বেরিয়ে এসেছিল তার। তবে এখন আবার সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। নিজের জন্য নয়। সামনে বসে থাকা মানুষটার জন্য। এই মানুষটার সামনে মায়া দূর্বল হতে চায় না, ভেঙে পরতে চায় না। এই জন্যই নিজেকে সামলে নেয়া মায়ার। নাহলে তার অবচেতন মনটাও চায় খুব প্রিয় কাউকে, আপন কাউকে, নিজের কাউকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে চোখের পানি, নাকের পানি এক করতে। কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ার পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব নয়।
মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে নওয়াজের মুখের দিকে তাকায় মায়া। মায়ার মুখে হাসি দেখে আরও অবাক হয় নওয়াজ। ভেতরে ভেতরে তার সবটা দুমড়ে, মুচড়ে আসছে। তার পেছনে মেয়েটাকে কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে। দুনিয়ার সব চাইতে ভয়ংকর রূপটার সম্মুখীন হতে হয়েছে শুধু মাত্র মাথার উপর কোনো ছায়া ছিল না বলে। তবু হয়ত ছায়া নামক বোনটা ছিল বলে এখনো বেঁচে আছে তার মুনমুন। নাহলে দুই দুইটা খুনের দায়ে হয়ত অনেক আগেই তার ফাঁসি হয়ে যেত। অথচ ভালোবেসে এই মেয়েটাকে আগলে রাখার স্বপ্ন দেখেছে নওয়াজ মনে মনে যা সে পূরণ করতে পারেনি। হেফাজতই যদি করতে না পারলো তাহলে আর কিই বা ভালোবাসলো সে! তাই নিজের ভালোবাসায় অপারগ আজ নওয়াজ। সেই সময় অন্তত সে দেশে থাকলে তার মুনমুনের জীবনে এতো ঝড় তুফান আসতো না। সে আগলে রাখতো তার মুনমুনকে পৃথিবীর সব কালো রূপ থেকে।
নওয়াজকে চুপ করে থাকতে দেখে মায়া নিজেই জিজ্ঞেস করে, “কী হলো চুপ হয়ে গেলে যে?”
মায়ার ডাকে ও প্রশ্নে হুঁশ হয় নওয়াজের। নওয়াজের হুঁশ হতেই মায়া আবার বলল, “আর কিছু বলবে না?”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নওয়াজ জিজ্ঞেস করে, “পরে ছায়া আপুর সাথে কী হয়েছিল জানো কিছু?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়া বলল, “না, তারপর আমি আর ঐ মুখো হইনি। তাই জানি না আপুর সাথে কী হয়েছে। সে বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না।”
“কখনো জানার চেষ্টা করোনি?”
“না।”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে নওয়াজ বলল, “তোমাদের ফ্ল্যাটটা কে যেন বিক্রি করে দিয়েছে।”
“তুমি গিয়েছিলে!” মায়ার কন্ঠে অবাক হওয়া স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
“তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। তোমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আমি পাগলের মতো তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু অতো দূরে বসে থেকে কিছুই করতে পারছিলাম না। আমার হয়ে রিফায়াত অসংখ্য বার তোমার খোঁজ করার চেষ্টা করেছে। তোমার বাসা, কলেজ কিছুই বাদ রাখেনি ও কিন্তু কোথাও তোমার কোনো খবর পায়নি। পরের বছরই রিফায়াতও অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। তারপর আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। মাঝে আমি দেশ চলে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার কাছে। এবার সুযোগ হতেই চলে এলাম তোমাকে খুঁজতে। দুইটা মাস আসার পর থেকে পাগলের মতো হন্য হয়ে তোমাকে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি। এমন কোনো জায়গা বাদ রাখিনি খুঁজিনি। প্রথমে তোমার খোঁজ করতে তোমার বাসায় যাওয়ার পর জানতে পারি তোমরা নাকি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছো। কোথায় গেছো জানতে চাইলে সেটা আর বলতে পারে না কেউ। বাড়ির দাড়োয়ানের কাছে জানতে চাইলে সেও বলল কিছু জানে না। তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার বাবা-মাকে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে মাটি দিয়া হয়েছিল সেই থেকে ভাবলাম হয়ত তাদের কবর জিয়ারত করতে আসবে কখনো না কখনো। সেই আশায় প্রতি শুক্রবার আমি মোহাম্মদপুর কবরস্থানে গিয়েছি। কিন্তু একদিনও তোমাকে পাইনি। দেশে যে বন্ধ-বান্ধব আছে শেষমেষ ওদের স্মরণাপন্ন হই আর কীভাবে তোমাকে পাওয়া যায় ভেবে। কোনো উপায়ান্তর বাদ রাখিনি আমি। আজও বন্ধুর বাসা থেকেই ফিরছিলাম। কি মনে করে যাওয়ার পথে ভাবলাম কবরস্থানটা হয়ে যাই। সবসময় তো শুক্রবারেই যাই। সপ্তাহের মাঝে যাওয়া হয় না। আমি কী জানতাম আজ গিয়েই দেখবো রাস্তার আইলেনের উপরে বসে আছো তুমি।”
এতটুকু বলে থামে নওয়াজ। সবটা শুনে মায়া বলল, “আমাকে দেখে চিনতে পেরেছো তুমি?”
“চিনতে পারবো না? যাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি তাকে দেখলে চিনবো না তা কী হয়? তোমাকে তো অন্ধকারে দেখলেও আমি চিনতে পারবো।”
এই মুহূর্তে মায়ার ভীষণ ইচ্ছে করছে নওয়াজকে একবার জড়িয়ে ধরতে। তার বুকে নিজেকে সপে দিতে। কিন্তু কোথাও একটা দ্বিধায় মায়া পারছে না নওয়াজের বুকে মাথা রাখতে। হয়ত জায়গাটা আর তা নেই বলে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে মায়া বলল, “তুমি একা যে তোমার বাবা-মা কোথায়?”
“বড় ভাইয়া লন্ডন সিফট হয়ে যাওয়ার পর বাবা মাকে নিয়ে আমাদের খুলনার বাড়িতে চলে গেছেন। তারা জানেন না আমি দেশে এসেছি। জানতে পারলে আমাকে খুলনা নিয়ে যেতেন। কিন্তু আমি শুধু তোমাকে খুঁজতে এসেছি তাই তাদের জানাইনি।”
“যদি আমাকে না পেতে?”
“হয়ত আপাতত খালি হাতে ফিরে যেতাম তবে আবার ফিরে আসতাম তোমাকে খুঁজতে। বারবার ফিরে আসতাম।”
তাদের কথায় কথায় কখন রাত ফুরিয়ে গেছে তা দুজনের একজনও টের পায়নি। রাত ফুরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। আচমকা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মায়া বলল, “আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
নওয়াজ তখনও নিচেই বসা ছিল। মুখ উপরে তুলে মায়ার মুখের দিকে তাকায় সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে কিছু বলে না। মায়া চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই নওয়াজ উঠে মায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “আমি তোমার জন্য এসেছি মুনমুন।”
মৃদু হেসে মায়া বলল, “আমাকে তো পেয়েছোই।”
“আমি তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। তুমি যাবে না?”
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় মায়া। বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার। মায়া মুখ ফুটে বলতে পারছে না ‘নওয়াজ আমাকে এই অন্ধকার থেকে তোমার ঝলমলে আলোর দুনিয়ার নিয়ে যাও প্লিজ। আমি যাবো তোমার সাথে। আমাকে নিয়ে যাও।’ মায়া জানে ঝলমলে দুনিয়ার সেই আলো আর তার জন্য নয়। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে মায়া বলল, “তা তো আর সম্ভব নয় নওয়াজ।”
“কেন সম্ভব নয়!”
“তোমার আমার দুনিয়াটা যে আর এক নেই। তুমি পৃথিবীর রঙিন অংশে আছো আর আমি অন্ধকারে ডুবে আছি। তাই তুমি যা চাও তা আর সম্ভব নয়।”
“তুমি চাইলেই সম্ভব। আমার দুনিয়ার সবটা রঙ দিয়ে আমি তোমার জীবন পাল্টে দিবো।”
“হয়ত আমার আগামী দিন গুলো তুমি পাল্টে দিতে পারবে কিন্তু আমার অতীত! তা তুমি কেন কেউ কখনো পাল্টাতে পারবে না। কেউ না। রঙিন দুনিয়াটা আর আমার জন্য নয়।”
নওয়াজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মায়া চলে যায় কাপড় পাল্টে নিতে। কাপড় পাল্টে নওয়াজের দেয়া কাপড় হাতে নিয়েই বেরিয়ে আসে সে। হাত বাড়িয়ে তার কাপড় তাকে ফেরত দিয়ে মায়া ছোট্ট করে আসি বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে নওয়াজ বলল, “তিনদিন পর আমার ফ্লাইট মুনমুন।”
বুকের ভেতর কিছু একটা কামড়ে ধরলো মায়াকে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে পেছন ঘুরে মায়া বলল, “ভালো থেকো তুমি। এরপর হয়ত আমাদের আর দেখা হবে না।”
নিজের যা বলার বলেই বড় বড় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল মায়া। নওয়াজকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। সে কিছু বলতে চায় কিনা তাও জিজ্ঞেস করলো না। অবশ্য এতক্ষণে মায়ার বুঝা হয়ে গেছে নওয়াজ তাকেই চায়। যা মায়ার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। নষ্ট হয়ে যাওয়া নিজেকে কীভাবে দিবে সে তার নওয়াজকে। এমন অন্যায় সে এই মানুষটার সাথে করতে পারবে না।
নওয়াজ মায়ার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো।
.
চলবে…