মায়াকথন পর্ব-৫ | Mayakathon -5 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

-এই পর্যন্ত সবটাই আমি জানি মায়া। কিন্তু তারপর তো তুমি তোমার বোন ছায়া আপুর সাথে থাকতে শুরু করলে তাহলে কী এমন হলো?
এবার মুখ তুলে তাকায় মায়া নওয়াজের দিকে। ঘেন্নায় ভেতর থেকে গুলিয়ে আসতে লাগে মায়ার।
মায়ার চোখে স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পায় নওয়াজ। মায়ার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে নওয়াজ জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছিল আমার মুনমুনের সাথে?”
মায়ার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তারপর মায়া বলতে শুরু করল,
“এ্যাক্সিডেন্টে বাবা-মা মারা গেলেন। আমি মারা না গেলেও গুরুতর ভাবে আহত হই। দিন দশের মতো হাসপাতালে ছিলাম। সেখান থেকেই ছায়া আপু তার সাথে তার বাসায় নিয়ে গেল আমায়। তখন তো আপু আর দুলাভাই একা। আপুর বাসা মিরপুরে। আমি সেখানেই আপুর সাথে থাকতে লাগলাম। আমাদের মোহাম্মদপুরের বাসাটা খালি পরে রইল। আব্বু-আম্মুর হুট করে চলে যাওয়াটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারিনি। আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সাথেও তখন খুব কম যোগাযোগ হতো। বাসায় সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতাম বলে আপু জোর করে আমাকে কলেজে ভর্তি করে দিলো। প্রথমে কলেজে ভর্তি হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। হুট করেই আব্বু-আম্মুকে হারিয়ে জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। তারপর আপু আমাকে আব্বুর স্বপ্নের কথা মনে করিয়ে দিলো। যতটা আমি চাইতাম আমি ডাক্তার হবো তার চাইতে বেশি আব্বু চাইতো তার মেয়ে বাংলাদেশের মস্ত বড় একজন ডাক্তার হবে। শতশত মানুষের চিকিৎসা সেবা করবে। দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আব্বুর কথা চিন্তা করে আমি কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাসায় যাওয়ার জন্য আমি প্রায় বায়না ধরতাম কিন্তু আপু আমাকে যেতে দিতো না। এ্যাক্সিডেন্টের পর ৫ মাস আমি আপুর বাসায়ই ছিলাম। হঠাৎ একদিন রাতে আপুর রুম থেকে অনেক চিল্লাচিল্লির শব্দ পেলাম। আমি থাকতাম গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমটাই আমার থাকার স্থায়ী রুম হয়ে গিয়েছিল যা আপুর বেড রুম থেকে কিছু দূরে তাই চিল্লাচিল্লির শব্দ ভেসে আসলেও ভেতরে ঠিক কী বলছে তা বুঝাতে পারিনি আমি। তবে এটা বুঝেছিলাম চিল্লাচিল্লি দুলাভাই করছিলেন। আপুর একটা টু শব্দও শুনতে পাইনি। পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে আপুকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম দুলাভাই কেবল চিল্লাচিল্লি করেননি আপুর গায়ে হাতও তুলেছেন। নাস্তার টেবিলে আমি আপুকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। দু’দিন সে চোরের মতো আমার থেকে চোখ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। তাই আমিও দু’দিন কিছু জিজ্ঞেস করেনি তবে খুব ভেবেছি হঠাৎ এমন কেন হলো। আমি ভাবছিলাম কোনোভাবে এর জন্য আমি দায়িত্ব কিনা। এমন হতেই পারে আমার এখানে থাকাটা দুলাভাই পছন্দ করছে না। তার ঘাড়ে থাকছি, খাচ্ছি সে পছন্দ নাও করতে পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দু’দিন পর আমি আপুকে চেপে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম দুলাভাই আমার এখানে থাকাটা অপছন্দ করছে কিনা যদি এমন হয় তাহলে আমি সেদিনই চলে যাবো। বোনের সংসারের অশান্তির কারণ আমি হতে চাই না। আপু আমাকে বলল, আমি বেশি বেশি ভাবছি এমন কিছু নয়। দুলাভাই নাকি তার ব্যবসার কাজ নিয়ে একটু চিন্তিত সে থেকে আপুর সাথে একটু রাগারাগি হয়েছে এর বেশি কিছু নয়। আমি আর কথা বাড়াইনি আপু যা বলেছিল তাই মেনে নিলাম। কিন্তু আপু আর দুলাভাইয়ের রাতের চিল্লাচিল্লি থামলো না। প্রায় প্রতিদনই আপুর রুম থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ পাওয়া যায়। আমি আর আপুকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তার সপ্তাহ দুই পরের কথা একদিন বিকেল বেলা আপু হুট করেই আমার রুমে এসে বলল, তুই একা বাসায় গিয়ে থাকতে পারবি? হুট করে আপুর এমন কথায় আমি বেশ অবাক হই কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করিনা কেবল বলেছিলাম পারবো। আপু তৎক্ষণাৎ আমাকে ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে একটা সিএনজিতে তুলে দিলেন। হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন কয়টা দিন ম্যানেজ করে নিতে আর যেন নিজের একটু ব্যবস্থা করে নেই। আপুর কার্যকলাপ দেখে আমি বেশ অবাক হই। হুট করে কি এমন হলো? যে বোন আমাকে এতদিন আগলে রাখলো সেই আজ আমার হাত ছেড়ে দিলো। কিছু একটা হয়েছে তা আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম। আপু আমাকে কিছু বলেনি আর আমিও বলার বা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি। চলে এলাম বাসায়। একাই থাকতে লাগলাম। যেহেতু আমার লেখাপড়ার একটা খরচ আছে, খাওয়া খরচ আছে। তাই ঠিক করলাম। ফ্ল্যাটটা ভাড়ায় দিবো আর আমি কোনো ভালো একটা হোস্টেলে উঠে যাবো। এতে অন্তত কলেজটা কাভার করতে পারবো আমি নিজেই। আব্বু ব্যাংকে টাকা রেখে গেছেন। কিন্তু তখনই আমি সেই টাকায় হাত দিতে চাইনি। পরে মেডিলেকে ভর্তির সময় অনেক টাকা লাগবে। তখনই ব্যাংকে রাখা টাকায় হাত দিলে পরে মেডিলেকে পড়বো কীভাবে? তাই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে দিবো ঠিক করলাম। তার আগে দামি দামি যতো জিনিস ছিল বাসায় সেগুলো বিক্রি করে ফেলবো ভাবলাম। শুধু নিজের জন্য আব্বুর ল্যাপটপটা রেখে দিবো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে দু’দিন পরেই আপু আর দুলাভাই আমার বাসায় এসে উঠলেন। তাদের দেখে আমি অনেক অবাক হয়েছিললাম কারণ দুলাভাই যে আবার আপুর গায়ে হাত তুলেছে তা আপুকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম। আমাকে অবাক হতে দেখে হেসে হেসে দুলাভাই বলেছিলেন, তোমার আপু বলল তুমি নাকি আমাদের বাসায় কমফোর্ট ফিল করছো না তাই এখানে চলে এসেছো। আমরা কী তোমাকে একা থাকতে দিতে পারি বলো? তাই ভাবলাম তুমি যেহেতু আমাদের বাসায় কমফোর্ট না তাহলে আমরাই না হয় এখানে চলে আসি। তুমি ছোট মানুষ একা কীভাবে থাকবে বলো। আমি সেদিন জবাবে কিছুই বলিনি। আপুর চোখে সেদিন আমি স্পষ্ট ভয় দেখেছিলাম। কিন্তু জানতাম না সেই ভয়ের কারণ টা কী!”
এতটুকু বলেই মায়া নওয়াজকে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার মনে আছে আমি তোমাকে বলেছিলাম আপু আমার বাসায় চলে এসেছে।”
“হ্যাঁ মনে আছে। আপু চলে এসেছে শুনে আমি অনেক স্বস্তি পেয়েছিলাম এটা ভেবে তোমাকে আর একা থাকতে হবে না।”
“হ্যাঁ।”
“তারপর?”
“তারপর, সপ্তাহ খানিক ঠান্ডাই গেল। তারপর একদিন হুট করেই আপু আমার রুমে এলো রাত করে। সেদিন দুলাভাই বাসায় আসেনি। এসে আমাকে বলল আপু প্রেগন্যান্ট। আমি কী যে খুশি হলাম এটা শুনে। কিন্তু আপু বলল, এটা তার প্রথম বাচ্চা নয়। এর আগে সে আরও ২ বার কনসিভ করেছিল কিন্তু দুলাভাই তা রাখতে দেয়নি। এই বাচ্চাটাও প্রথমে তিনি রাখতে চাইছিলেন না।”
“ওয়াট! কিন্তু কেন?”
“বলছি। আমিও তোমার মতোই অবাক হয়ে ছিলাম সেদিন। জিজ্ঞেস করলাম, কেন আপু? আপু জবাবে বলেছিল,
.
চলবে…

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads