পতিতা পর্ব-২১ | Potita -21 লেখিকাঃ ইতি চৌধুরী

আমি পিছন ঘুড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। নক দিয়ে তার শার্ট খামচে ধরে তার বুক ভিজাতে লাগলাম।

সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলেন নিজের বুকে। যেনো কখনো ছাড়বেন না। হারাতেও দিবেন না।

আমার দিন স্বাভাবিক হতে থাকে। বাসায় সময় দেয়া আর রাতে তার কাছে আসা। প্রতিদিনই সে আমাকে নিয়ে যায় আবার দিয়ে যায়। বাবা ইদানিং আবার খুব চিন্তা করেন। কিন্তু কাউকে কিছু বলেন না। আমি জানি আমােক নিয়েই বাবার এতো চিন্তা। পড়ােলেখার খুব শখ ছিলো আমার সেটা তো শেষ করতে পারলাম না। এখন বোনদের দিয়েই শখ পুরণ করব।

রেনু কি কখনো বুঝবে না আমি কতটা চাই মেয়েটাকে। কেনো এতো পাগল হয়ে যাই আমি ওর জন্য। কি আছে ওর মাঝে??? শুধু কি রাতে ওকে কাছে পাওয়ার জন্যই??? না তা তো হতে পারে না। ওকে আমার জীবনের প্রতি রাতে চাই৷ প্রতিদিনে চাই। প্রতি মুহূর্তে চাই। ও কি বুঝবে না অয়ন ওকে চায়। এভাবে অয়নের মনে মনে রেনুর ভাবনা খেলা করে বেড়ায় সারাদিন। কিন্তু কোন ভাবেই তা অয়ন নিজে প্রকাশ করতে পারছে না।

ইদানিং আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। সারাদিন অস্থির লাগে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়ায়ও করতে পারছি না। মাথা ভার হয়ে থাকে।

মা- কিরে এখনো শুয়ে আছিস???

রেনু- এইতো মা উঠছি।

উঠে দাড়াতেই মাথাটা চক্কোর দিয়ে উঠল। আমি পড়ে যেতে নিয়ে মাকে ধরে বসে পরলাম।

মা- কিরে কি হলো??

রেনু- না কিছু না। হুট করে উঠেছি তো তাই হয়ত মাথাটা একটু ঘুড়ে উঠল।

মা- এতো চিন্তা কেনো করিস। নিজের তো একটু খেয়ালও রাখিস না। মাথা তো ঘুড়াবেই৷ খাবারটাও ঠিক মতো খাস না। তুই বস আমি আসছি।

আমি নিজের খেয়াল না রাখলেও আমার আশেপাশের মানুষগুলো তো ঠিকি খেয়াল রাখছে। বাসায় মা অনু তনু ঐদিকে টুুনি সাথে ঐ মানুষটাও তো আছে। আমি নিজের যত্ন না করলেও এই মানুষগুলো ঠিকি আমার যত্ন করছে। তাহলে তো এমন হওয়ার কথা নয়। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে দেখে উঠে পরলাম। সারাদিন কোন কাজ করি নি তাও এতো ক্লান্ত কেনো লাগে বুঝি না। গাড়ি করেই আসলাম। তাও মনে হয় কত খাটনি করেছি যে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সে এখনো আসে নি। অফিসে নাকি অনেক কাজ। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে শুয়ে পরলাম। শুয়ে পরতেই যেনো আমার চোখে রাজ্যের ঘুম চলে এলো।

কারো স্পর্শে আমার চোখ খুলে গেলো। তাকিয়ে দেখি টুনি। আমার কপালে হাত দিয়ে দেখছে আমার জ্বর এসেছে কি না??

টুনি- আপনি তো অসময় ঘুমান না তাহলে আজ কি হলো???

রেনু- ক্লান্ত লাগছিলো খুব তাই চোখ লেগে গিয়েছিলো।

টুনি- তা তো হবেই। নিজের তো আর খেয়াল রাখেন না।

রেনু- আমি না রাখলে কি হয়েছে তুমি তো রাখো।

টুনি- হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না। এখন উঠে পরুন খেতে হবে। নিচে যাওয়া লাগবে না। আমি খাবার উপরেই নিয়ে আসছি।

রেনু- আমার না খেতে একদম ইচ্ছে করছে না।

টুনি- কি বললেন???

খাবো না বলতেই টুনি হুংকার দিয়ে উঠে। অগত্যা বাধ্য হয়েই খেতে বসতে হলো। এক লোকমা খাবার মুখে দিতেই আমার যেনো ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসছিলো। আমি কিছুতেই গিলতে না পেরে দৌড়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম।

টুনি- আপনি ঠিক আছেন তো???

রেনু- হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।

টুনি- আমি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি।

রেনু- না না তার প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই দেখিয়ে নিবো।

টুনি- আপনি যে দেখাবেন না তা আমি ভালো করেই জানি।

রেনু- না সত্যি দেখাবো।

টুনি- সত্যি তো???

রেনু- হ্যাঁ সত্যি। এখন তোমার স্যারকে কিছু বলো না প্লিজ।

টুনি- ঠিক আছে।

আমি বলায় টুনি অয়নকে কিছু বলেনি। আমার নিজেরও ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম ডাক্তার দেখিয়েই নেই। আমি অসুস্থ হয়ে গেলে বাকিদেরকে কে দেখবে। তাই পরের দিনই ঠিক করি একবার আঙ্কেল কে দিয়ে আসি। ফোন দিয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে গিয়েও নিলাম না। বাসায় কেউ জানতে পারলে আবার বাবা মা শুধু শুধু চিন্তা করবেন।

দুপুরের পরপরই বেরিয়ে গেলাম হসপিটালে যাওয়ার জন্য। পথেই তুবা আপুর ফোন আসে।

তুবা- কেমন আছিস??

রেনু- আমি তো ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো???

তুবা- কেমন ভালো আছিস তা তো আমি ভালোই জানি। তুই কোথায় গাড়ির শব্দ পাচ্ছি।

রেনু- একটু হসপিটালে যাচ্ছি।

তুবা- আবার হসপিটাল কেনো??? আবার কি…

রেনু- না না বাবা ঠিক আছেন। আমি যাচ্ছি আমার জন্য।

তুবা- তোর কি হয়েছে???

রেনু- তেমন কিছু না। কয়দিন যাবত শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

তুবা- কি হয়েছে শুনি।

রেনু- আরে তেমন কিছুই না। তুমি চিন্তা করো না।

তুবা- যেমনই হোক আমাকে বল।

বাধ্য হয়ে তুবা আপনাকে সব বললাম।

তুবা- তুই কোথায় আছিস এখন???

রেনু- বললামই তো পথে আছি হসপিটাল যাচ্ছি। আঙ্কেলকে দেখিয়ে আসি একবার।

তুবা- কোথাও যাওয়া লাগবে না। আমি তোকে একটা ঠিকানা এসএমএস করছি সোজা সেখানে চলে আয়।

রেনু- কিন্তু কেনো???

তুবা- এতো প্রশ্ন না করে যা বলছি তাই কর। এখনি চলে আয়।

আপু হঠ্যাৎ এমন কেনো করল বুঝলাম না। তার দেয়া ঠিকানা মতোই চেলে গেলাম। পৌছে দেখি একটা ক্লিনিক। আমাকে দেখে আপু ভেতর থেকে দৌড়ে আসে।

রেনু- তু….

তুবা- তোর কি পিরিয়ত হয়েছিলো এই মাসে????

রেনু- আমার???

তুবা- হয়েছে???

রেনু- গত মাসের শুরুতে হয়েছিলো। তারপর এই মাসে তো এখনো….

তুবা- তুই আয় আমার সাথে।

আপু আমাকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। সে আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখেন। আমার নামে সিরিয়াল দেয়া থেকে শুরু করে সবি করে ফেলেছে। ক্লিনিকটা আপুর বাসার পাশেই ছিলো তাই সে আগে এসে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।

ভেতরে যেতেই ডাক্তার আমার চেকআপ শুরু করলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্লাড আর ইউরিন সেম্পল দিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজকেই রিপোর্ট দিয়ে দিবে। ৩০ মিনিট এর মতো সময় লাগবে।

আপুকে অনেক চিন্তিত লাগছে দেখতে। আপুর চিন্তা করা দেখে আমার নিজেরই ভয় লাগছে। আপু নিজেও কিছু বলছে না৷ আর আমি ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। একজন ডেকে উঠল।

– মিসেস রেনু।

তুবা- চল রিপোর্ট চলে এসেছে।

রেনু- মিসেস বলল যে??

তুবা- আমি দিয়েছি৷

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হচ্ছে কি। আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম।

ডঃ- আপনি পেশেন্টের কি হোন???

তুবা- বোন।

ডঃ- ভালো হয়েছে একা আসতে দেন নি। এসময় সাথে কেউ না কেউ থাকা ভালো। তবে সব চাইতে ভালো হয় হাজবেন্ড পাশে থাকলে।

তুবা- ওর হাজবেন্ডই আমাকে বলল ওকে নিয়ে আসতে। সে ব্যস্ত সময় পাচ্ছে না তাই৷

আমি ডঃ আর আপুর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের হাজবেন্ড। কার হাজবেন্ড। কিসের সময়।

তুবা- তাহলে ডঃ রিপোর্ট কি পজেটিভ এসেছে।

ডঃ জ্বি। আপনার বোন প্রেগন্যান্ট। সে মা হতে চলেছেন।

আমি প্রেগন্যান্ট। আপুই ডাক্তারের সাথে কথা বলেন। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে তার বাসায় চলে আসে। আমি প্রেগন্যান্ট এই কথা শুনার পর থেকে একটা কোথাও বলি নি। এখন বুঝতে পারছি আপু কেনো এমন করছিলো। সে আমার কথা শুনেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো। আর আমি তো আন্দাজ করা দূরের কথা ভাবিও নি এমন কিছু হতে পারে। আমার মাথায় ব্যাপারটা ছিলোই না। আমার ভেতরে আরেকটা জান আছে অথচ আমি বুঝতেই পারি নি। অয়ন চৌধুরীর সত্ত্বা আমার ভিতরে। অয়ন চৌধুরীর সন্তান। না আমাদের সন্তান।

তুবা- কবে করবি????

আপুর কথায় আমি চিন্তা জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসি।

রেনু- কিছু বললা??

তুবা- কবে করবি???

রেনু- কি???

তুবা- এবোর্শন

রেনু- এবোর্শন????

তুবা- হ্যাঁ, বাচ্চাটা ফেলে দিতে হবে।

রেনু- ফেলে দিবো??

তুবা- তা নয় তো কি??? তুই কি বাচ্চা রাখতে চাস নাকি???

রেনু- বাচ্চা…

তুবা- শুন এরা নিজেদের স্বার্থে আমাদের কাছে আসে। সংসার বা বাচ্চা জন্ম দিতে নয়। বাচ্চার কথা শুনলে সে নিজেই সরে যাবে তোর কাছ থেকে। আর নয়ত নিজেই বলবে মেরে ফেলতে।

আমি আপুর কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না। চুপ করে শুধু শুনেই গেলাম।

তুবা- আমি সব ব্যবস্থা করছি। দেড়ি না করাই ভালো। তুই দুই তিন দিনের জন্য আমার বাসায় চলে আয়।

রেনু- আমাকে দু দিন সময় দাও আপু।

তুবা- সময় দিয়ে কি করবি???

রেনু- প্লিজ আপু।

তুবা- ঠিক আছে। তুই নিজেকে মানষিকভাবে প্রস্তুত কর আগে৷ তবে বেশি সময় নিস না।

আমি বাসায় চলে এলাম। আজ বের হতে ইচ্ছে করছে না একা থাকতে ইচ্ছে করছে। তাই ফোন করে বলে দিলাম আমাকে নিতে আসতে না।

সবাই ঘুমিয়ে পরতেই আমি ছাদে চলে গেলাম। নিজের অজান্তেই আমার হাত আমার পেটে চলে যায়। এখানে একটা ছোট্ট সত্ত্বা আছে। আমার চোখ বেয়ে পানি পরতে শুরু করল। আমি কিভাবে মারবো ওকে। আমার সন্তানকে আমি কিভাবে মারবো??? ওর তো কোন দোষ নেই৷ তাহলে কেনো ও দেখবে না এই দুনিয়ার আলো। অয়ন চৌধুরী কি সত্যি ওকে নিজের নাম দিবে না??? দূর করে দিবে আমাদের কে????

.

চলবে…..

Related Posts

Leave a Reply

Direct link ads